পুরান ঢাকার পারফিউম লেন: সুগন্ধির পাইকারি বাজার
গন্ধ এমন এক অনুভূতি, যা আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া দিন, পুরোনো প্রেম, আর ফেলে আসা জীবনের নানা মুহূর্তের সঙ্গে মিশে থাকে। কোনো চেনা গন্ধ যখন নাকের কাছে আসে, অতীতের সুখস্মৃতি যেন এক লহমায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। দাদী-নানীদের নকশা তোলা কাঁথার চেনা গন্ধ, বৃষ্টির সোঁদা মাটি, কিংবা মায়ের চুলের তেলের গন্ধ—এগুলো আমাদের স্মৃতির অমূল্য অংশ। সত্যি করে বলুন তো, বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও বসে কারও চুল থেকে সে পরিচিত তেলের গন্ধ এলে মায়ের কথা মনে পড়েনি এমন কখনো হয়েছে?
সেই ছোট্টবেলার জন্মদিনে প্রিয় বন্ধুর থেকে উপহার পাওয়া পারফিউমের শিশিতে বোতলবন্দি হয় মুহূর্তরা। জীবনে যতবারই ঐ পারফিউম মাখবেন, মনে পড়ে যাবে সে বন্ধুর কথা। এভাবে স্মৃতিময় দিনের যেসব হিসেব ডায়েরিতে লেখা হয় না, তারা বেঁচে থাকে গন্ধে।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সে উপন্যাসের কথা মনে আছে? 'অন্য বসন্ত'। যেখানে ছেলেটি পারফিউম তৈরি করে। সে উপন্যাসের অভিমন্যুর কথা বলছি। অভিমন্যুর ঠিক আর পাঁচটা ছেলের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। কেমিস্ট্রিতে অনার্স শেষ করে সে একটি ছোটখাটো পারফিউমের ব্যবসা দাঁড় করাতে চায়, কারণ তার গন্ধ ভালো লাগে। অভিমন্যু এমন কোনো গন্ধ তৈরি করতে চায়, যেটা কেউ কখনো তৈরি করেনি—যে গন্ধে মিশে থাকে মন খারাপ আর ছুঁতে চাওয়ার আকুলতা, কিংবা ডানা মেলে শত ডানার প্রজাপতি।
'অন্য বসন্ত'-এর অভিমন্যু কিংবা কারও গায়ের গন্ধ শুঁকে সুগন্ধি বানানো দুবাইয়ের ইউসুফ ভাইয়ের মতো যারা গন্ধ তৈরি করে মানুষের মুখে হাসি ফোটান, আজকে সে গন্ধের ফেরিওয়ালাদের কথাই লিখব। তবে তার আগে সুগন্ধির ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া যাক।
সুগন্ধি যেমন করে এল
আদিকাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সুগন্ধির ব্যবহারের কথা জানা যায়। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন গাছের ডালপালা বা নির্যাসকে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করত। ঠিক কবে কখন সুগন্ধি তৈরি শুরু হয়েছিল, তা সাল তারিখ হিসেবে বলা মুশকিল। তবে গুহাবাসী মানুষ শিকার থেকে আত্মরক্ষা, শস্য ফলানো থেকে বস্ত্র ও বাসস্থানের পর আস্তে আস্তে নিজের সুকুমার বৃত্তিকে বিকাশ করতে চেষ্টা করেছিল। তারই প্রমাণ এ সমস্ত চমৎকার সুগন্ধি।
সে সময় থেকেই বিভিন্ন ধর্মে দেবতার উদ্দেশে সুগন্ধি পুড়িয়ে আত্মশুদ্ধির ধারণা প্রচলিত হয়ে পড়ে। উদ্ভিদ থেকে সুগন্ধি তৈরি সর্বপ্রথম শুরু করেন মিশরের বাসিন্দারা। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন, সুগন্ধির ধোঁয়া ও সৌরভের মধ্যে বেঁচে থাকেন ঈশ্বর। লাতিন শব্দ 'পার' (মাধ্যম) এবং 'ফিউম' (ধোঁয়া) থেকে 'পারফিউম' শব্দের উৎপত্তি, যা সুগন্ধির ধোঁয়ার মাধ্যমে স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ভাবনাকে বোঝায়। ব্যাবিলন, সুমেরীয়, আর অ্যাসিরীয় সভ্যতায়ও ধর্মাচরণে সুগন্ধির ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতের গ্রন্থ 'বেদ'-এ দারুচিনি, এলাচ, চন্দন প্রভৃতি সুগন্ধির উল্লেখ রয়েছে। 'বৃহৎসংহিতা', 'কল্পসূত্র', এবং 'গৃহসূত্র'-এর মতো গ্রন্থগুলো মনে করিয়ে দেয়, ভারতবর্ষের সুগন্ধির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। শুধু উদ্ভিদ, ফল এবং ফুলের নির্যাস দিয়েই যে সুগন্ধি তৈরি হতো, তা নয়। হরিণের নাভি (কস্তুরি) দিয়েও বিশেষ ধরনের সুগন্ধি প্রস্তুত করা হতো। তবে সেসব সুগন্ধি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। শুধুমাত্র ধনাঢ্য ও অভিজাত পরিবারের মানুষজন তা ব্যবহার করতে পারতেন।
আজকের যুগে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মিশিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি তৈরি করা হয়। সুগন্ধি তৈরির জন্য নানা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি রয়েছে। তবে সুগন্ধি বানাতে শুধু বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকলেই চলে না, থাকতে হয় শৈল্পিক সত্তা ও গন্ধকে অনুভব করার তীব্র ক্ষমতা। শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের মিশেলে তৈরি হয় একেকটি চমৎকার সুগন্ধি।
পুরান ঢাকার পারফিউম লেন
শীতকালের বিকেল মানেই কমলা রোদ্দুর পালাচ্ছে, ছুটে আসছে শীতল হাওয়া। এর মধ্যেই ঝুপ করে নেমে আসবে অন্ধকার। এমন এক গা শিরশিরে শীতের বিকেলে পুরান ঢাকার একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। হঠাৎই নাকে ভেসে এল একটা কোমল সুবাস। ঢাকা শহর বলতেই চোখে ভাসে আবর্জনার স্তুপ, নোংরা বিদঘুটে গন্ধ—সেখানে এত সুন্দর গন্ধ এল কোত্থেকে? খানিক এগোতেই বুঝলাম, ঢুকে পড়েছি পারফিউম লেনে।
ঢাকা শহরের পারফিউমের পাইকারি বাজার এটি। আসলে শুধু ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সুগন্ধি বাজার এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে সুগন্ধি বিক্রেতারা এখান থেকেই পাইকারিতে পণ্য কিনে নিয়ে যান। গুলিস্তান থেকে বাসে করে বাবুবাজার ব্রিজে নামলেই পাওয়া যাবে এ সুগন্ধির বাজার। অথবা গুলিস্তান থেকে রিকশা নিয়ে মিডফোর্ড হাসপাতালের সামনে নামলেও সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে পারফিউম লেন।
এ বাজারের সবচেয়ে প্রাচীন আর ঐতিহ্যবাহী দোকানের নাম জানতে চাইলে সবাই এক বাক্যে 'লাহোর কেমিক্যালস'-এর নাম বলল। পুরান ঢাকার মিডফোর্ড রোডের সুবিশাল পারফিউম মার্কেটের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে লাহোর কেমিক্যালসের নাম। প্রায় ৩০ বছর ধরে সৌদি আরব, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ভারত থেকে সরাসরি পারফিউম আমদানি করে এ প্রতিষ্ঠান।
দোকানে পৌঁছে দেখা গেল, থরে থরে সাজানো প্রায় হাজারখানেক পারফিউমের বোতল। সেখানে রাখা কোনো বোতলই ৫ থেকে ৮ লিটারের কম নয়। এসব বোতলে ব্র্যান্ডের নাম লেখা লেবেল লাগানো। ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের কাচের শিশিগুলোও চোখ এড়ায়নি। নানা নকশার শিশি দেখে মনে হলো, ঢুকে পড়েছি কোনো রাজবাড়িতে। এমন শিশিগুলোতে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণে সুগন্ধি ঢেলে দেওয়া হয়।
তখন সারাদেশ থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে ভিড় জমিয়েছেন লাহোর কেমিক্যালস-এ। তাই কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও দোকানির সঙ্গে খুব বেশি গল্প জমল না। কথা হলো লাহোর কেমিক্যালসের এক কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, আশির দশক থেকে এ মিডফোর্ড রোডে দোকানগুলো গড়ে উঠেছে। সে সময়ে কিছু কেমিক্যাল কারখানা থাকলেও সেগুলো সময়ের সঙ্গে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছে বহু পাইকারি ও খুচরা দোকান।
তিনি আরও বললেন, আগে দেশ-বিদেশ থেকে পারফিউম সহজেই আনা যেত। শুল্ক ব্যবস্থা নমনীয় ছিল, আর পাওয়া যেত খাঁটি পণ্য। কিন্তু বর্তমানে তা আর সম্ভব নয়। ভালো দাম দিলেও এখন অনেক সময় আসল পণ্য পাওয়া যায় না।
লাহোর কেমিক্যালস পেরিয়ে দেখা মিলল একটি দ্বিতল ভবনের। ভবনের সব দোকানেই আতর ও পারফিউম বিক্রি হয়। প্রথমতলার আটটি দোকানে আতরের ছোট ছোট শিশি সাজিয়ে রাখার চিরাচরিত দৃশ্য চোখে পড়ল। এখান থেকে ক্রেতারা পাইকারি ও খুচরা—দুইভাবেই আতর ও পারফিউম কিনতে পারেন।
একই রকম জমজমাট পরিবেশ দেখা গেল দ্বিতীয় তলাতেও। এ তলায় অবশ্য দোকানের সংখ্যা খানিকটা বেশি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা আতর হাতে মেখে ঘ্রাণের তীব্রতা পরীক্ষা করছেন। কেউ কেউ এক আতরের সঙ্গে অন্য আতর মিশিয়ে ঘ্রাণের ভিন্নতা পরখ করছিলেন। বুঝতে পারলাম, এ ভবনের ছোট-বড় সব দোকানে রয়েছে দেশসেরা সুগন্ধি ও আতরের সংগ্রহ।
এত বিশাল ব্যবসা, ঝলমলে পরিবেশ, জমজমাট ভিড় আর পুরনো দোকান পেরিয়ে এবার ঢুকলাম একটি ছোট্ট দোকানে। 'আব্দুল্লাহ পারফিউম' নামের এ দোকানটির বয়স বছর দেড়েক। আয়তনে ছোট হলেও এর পারফিউম, আতর ও সেন্টের সংগ্রহ বেশ ভালো। দোকানে প্রায় ২০০টির মতো সুগন্ধি বোতল রয়েছে।
দোকানের স্বত্বাধিকারী নূর আলম। ভাইকে নিয়ে তিনি এ দোকানের যাত্রা শুরু করেন। তিনি জানালেন, বেশিরভাগ পারফিউমই এনেছেন ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই এবং সৌদি আরব থেকে। তার থেকে জানা গেল, বাজারের সবচেয়ে বিখ্যাত আতর হল 'কাশ্মীরি উদ' এবং 'আমির আল উদ'।
এ দুই আতরের দাম প্রতি লিটার যথাক্রমে ৮ ও ১২ হাজার টাকা। এছাড়াও 'কস্তুরি' এবং 'জান্নাত'-এর মতো পুরোনো আতরগুলোর জনপ্রিয়তাও এখনো কমেনি। শোনা গেল, এহসাস আল আরাবিয়া, বিআর ৪৫, সালমা, চকো মাস্ক, রয়েল মিরেজ, ভিক্টোরিয়া সিক্রেট এবং কুল ওয়াটারের মতো পারফিউমের স্তুতিও।
বাজারের পরিচিত ব্র্যান্ড, যেমন ফগ, অ্যাক্স বা ওয়াইল্ডস্টোনের মোড়কে ইচ্ছেমতো পারফিউম তৈরি করিয়ে নেওয়া যায় এ দোকান থেকে। আবার, বিশেষ অর্ডার দিলে সরাসরি বাইরের দেশ থেকেও আসল আতর বা সেন্ট এনে দেওয়া হয়। এ তুলনামূলক ছোট দোকানগুলোর সুবিধা হলো, খুব অল্প পরিমাণেও পারফিউম কেনা সম্ভব। বড় দোকানগুলো অনেক সময় এ সুবিধা দেয় না। নিজের পছন্দমতো সুগন্ধি খুঁজে পাওয়ার জন্য এ ছোট দোকানগুলো বেশ আরামদায়ক। তাছাড়া এখানে ভিড়ও তুলনামূলক কম থাকে।
বাইরের বাজার
ইদানিং অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও ছোট বোতলে পারফিউম অয়েল বিক্রি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 'অবসেশন' নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে নারীদের সুগন্ধি বিক্রি করেন জিয়াউর রহমান। তার বাবার মিডফোর্ড রোডে পারফিউমের ব্যবসা প্রায় ৪০ বছরের। করোনার সময়ে বাড়িতে বসে জিয়া তার বাবার ব্যবসা বাড়ানোর কথা ভাবছিলেন। তখন ফেসবুক মার্কেটিং-এর কথা তার মাথায় আসে। কাজ শুরু হয় মাত্র ৩৫ জন ফলোয়ার নিয়ে। এখন সে পেজের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৯৮ লাখ।
মিডফোর্ড রোডের দু'পাশের পারফিউমের দোকানের কথা অনেকেই জানেন। তবে এখানকার দোকানগুলোতে সুগন্ধির পাশাপাশি নানা ধরনের রাসায়নিকও পাওয়া যায়। পারফিউম লেনের বড় দোকানগুলোতে প্রায় সব ধরনের এসিড, ক্ষারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক মজুত থাকে। বোরহান, বৈশাখী, রয়েল এবং বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো মাঝারি দোকানগুলোতে ঘুরে বোঝা যায়, দোকানের মালিকেরা কেবল পারফিউমেই নয়, রাসায়নিকের ব্যবহারেও দক্ষ। কেতাবি শিক্ষা না থাকলেও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ দক্ষতা অর্জন করেছেন তারা। এমনই এক দোকানে এক ক্রেতা হারপিক বানানোর জন্য হাইড্রোক্লোরিক এসিড কিনতে এসে দোকানির সঙ্গে ফর্মুলা নিয়ে আলাপ করছিলেন। বানানোর ফর্মুলা নিয়ে দোকানির সঙ্গে ক্রেতার কথোপকথন বলে দিলো, দোকানি কতখানি অভিজ্ঞ।
আজকাল পকেট পারফিউমের চাহিদা বেড়েছে। ঢাকা শহরের লোকাল বাসগুলোতে ছোট বোতলে পারফিউম ফেরি করে বিক্রি করতে দেখা যায়। ফুটপাতের দোকানগুলোতেও ৫০-১০০ মিলির পারফিউমের বোতল পাওয়া যায়, যার দাম ১০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে। এখানে নরম ও মিষ্টি গন্ধ থেকে শুরু করে ঝাঁঝালো গন্ধ পর্যন্ত সবই পাওয়া যায়। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় ক্লান্ত মানুষজন এসব আতর বা পারফিউম কিনে নেন।
ইতিহাস বলে, পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে দুর্গন্ধ বেশি ছিল, সেসব জায়গায় সুগন্ধি শিল্প বিকশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের কথা বলা যায়। ট্যানারির দুর্গন্ধ দূর করতে ফ্রান্সে সুগন্ধি শিল্পের সূচনা হয়, যা আজ বিশ্ববিখ্যাত। এ বিবেচনায় ঢাকা একটি সম্ভাবনাময় স্থান। সুগন্ধি আমদানি কমিয়ে বাংলাদেশ নিজস্ব পারফিউম শিল্পের দিকে ঝুঁকতে পারে। কে জানে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পারফিউম হয়তো দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করার পাশাপাশি আনতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা।
ছবি: টিবিএস