সনি স্কয়ারের বিবর্তন: পোশাক কারখানা থেকে আধুনিক বিনোদন কেন্দ্র
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে মিরপুর আজকের মতো এত ব্যস্ত ছিল না। মিরপুরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাও পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ওই সময়ের শেষ দিকেই তৈরি হয় ঐতিহাসিক স্থাপনা সনি স্কয়ার। শুরু থেকেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সময়ের পরিক্রমায় এটি এমন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে নতুন রূপ পেয়েছে এবং শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজের কৃতিত্ব জাহির করছে।
৪০ বছরের পুরোনো ভবনটিকে ২০২১ সালে আধুনিক বিনোদন কেন্দ্রে রূপ দেওয়া হয়। এখানে রয়েছে সনি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের কর্পোরেট অফিস, একটি শপিং কমপ্লেক্স, ফুড কোর্ট এবং একটি সিনেমা হল। স্থপতি আল মামুন উর রশিদ ও তার প্রতিষ্ঠান আমুর আর্কিটেক্টসের তত্ত্বাবধানে চলে এর সংস্কার কাজ। ছয় মাসের সংস্কার কাজ শেষে ৪০ বছরের পুরোনো ভবনটি পায় নতুন চেহারা।
আজকের সনি স্কয়ার এখন একটি জমজমাট লাইফস্টাইল হাব। এখানে সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে। এখানে রয়েছে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের রিটেইল শপ, একটি ফুড কোর্ট, একটি রুফটপ রেস্টুরেন্ট। কেনাকাটা থেকে শুরু করে বন্ধু বা প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য এটি এখন একটি চমৎকার জায়গা।
স্থপতি মামুন ও তার দলের লক্ষ্য শুধু একটি ভবন নির্মাণ ছিল না। তিনি বলেন, "মিরপুরের খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কাছেই মেট্রো স্টেশন থাকায় আমরা এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছি যা এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমানকে আরও উন্নত করবে। একে এমন স্থানে পরিণত করেছি যেখানে মানুষ এক ছাদের নিচে কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া ও সামাজিকতা করতে পারবে। এখানে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছি যা মিরপুরের জন্য গৌরবের।"
মিরপুরের বাসিন্দাদের জন্যই নয়, বরং সবার কাছে সনি স্কয়ার শুধু একটি ল্যান্ডমার্ক। এটি মিরপুরের সম্ভাবনাময় অবস্থার একটি প্রতীক যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধুনিকতা একসঙ্গে মিশে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে।
একটি পোশাক কারখানা থেকে আধুনিক স্থাপনা
এক সাক্ষাৎকারে কমপ্লেক্সের মালিক মোহাম্মদ হোসেন জানান, ১৯৮১ সালে দুই ও আধা বিঘা জমির ওপর সনির নির্মাণকাজ শুরু হয়। মূলত এটি একটি পোশাক কারখানা হিসেবে গড়ে ওঠা ভবনটি বহু বছর ধরে বিভিন্ন শিল্প কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র ছিল। ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট বাংলা চলচ্চিত্র 'লড়াকু' প্রদর্শনের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তীতে মালিকের মেয়ের নামে ভবনটির নামকরণ করে রাখা হয় 'সনি সিনেমা হল ও মার্কেট'। তিন তলাবিশিষ্ট এই সিনেমা হল উদ্বোধনের পর বিনোদন জগতের এক উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে ওঠে এটি। এখানে তিনটি আলাদা সিনেমা হল ছিল, যার মধ্যে দুটি ছিল সে সময়ের অন্যতম বড় হল।
বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মিরপুরও বদলেছে। একসময়ের শান্ত আবাসিক এলাকা পরিণত হয়েছে ব্যস্ত নগরকেন্দ্রে। তবে সে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি সনি সিনেমা হল। ধীরে ধীরে সিনেমার পর্দা নিভে যায়, বাজারের কোলাহল থেমে আসে, আর মিরপুরের প্রাণচাঞ্চল্যের প্রতীক হয়ে ওঠা এই স্থাপনা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে বিস্মৃতির আড়ালে।
কিন্তু প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী স্থানেরই থাকে দ্বিতীয় অধ্যায়, আর সনি সিনেমা হলও তার ব্যতিক্রম নয়। যখন ভবনটিকে পুনরায় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল এটি সম্পূর্ণ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা।
তবে এর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, অনন্য স্থাপত্যশৈলী এবং দ্রুত বিকাশমান ঢাকার এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হওয়ায় পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়। আমুর আর্কিটেক্টসের আল মামুন উর রশিদ ও তার দল ভবনটির অপার সম্ভাবনা দেখতে পান।
মামুন উর রশিদ বলেন, "আমরা চাইলে সম্পূর্ণ নতুন করে শুরু করতে পারতাম, কিন্তু এই ভবনের ইতিহাস ও বিশেষত্ব সংরক্ষণ করা জরুরি ছিল। এর ঢালু র্যাম্প, ঐতিহ্য সবই নতুন করে আমাদের ভাবিয়েছে।"
স্থপতি দলটির লক্ষ্য ছিল পুরোনো ও সময়ের সঙ্গে বেমানান হয়ে পড়া সিনেমা হল ও মার্কেটটিকে একটি আধুনিক শপিং কমপ্লেক্সে রূপ দেওয়া। এর মাধ্যমে এর ইতিহাসকে ধরে রাখা হয়েছে।
চার দশকের বেশি পুরোনো একটি ভবনের সংস্কার কাজ ছিল নিঃসন্দেহে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। দলটি প্রথমে ভবনের ভিত্তি শক্তিশালী করার কাজে মনোযোগ দেয়, নতুন কাঠামোর ভার বহনের জন্য উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ২০০-র বেশি কলাম পুনর্নির্মাণ করা হয়।
মামুন স্বীকার করেন কাজটি চ্যালেঞ্জিং ছিল। তিনি বলেন, "আমাদের কলামগুলোতে অতিরিক্ত জ্যাকেটিং করতে হয়েছিল যাতে তারা আধুনিক সংযোজনগুলোর ওজন বহন করতে পারে। ঐতিহ্য রক্ষা করতে এটি ছিল উপযুক্ত পদক্ষেপ।"
অফিস স্পেস বিনোদন কেন্দ্র থেকে আলাদা
সনি স্কয়ারের ভবনটি বিভিন্ন সেকশনে বিভক্ত। এর মধ্যে সনি স্কয়ারের অফিস স্পেস রয়েছে। এছাড়া রয়েছে শপিং মল, লবি, ফুড কোর্ট এবং একটি রুফটপ রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টটি একটি বিশাল পাঁচ তলা উঁচু অ্যাট্রিয়াম দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে।
ভবনটির সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে গিয়ে স্থপতি অফিসের জন্য বরাদ্দ জায়গাটি পরিবর্তন করেন। সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের জায়গার জন্য একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। এই জায়গাটিই এখন ভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে।
স্থপতি মামুন নিজের শৈশবে পদ্মার পাড়ে গ্রামীণ জীবন, সেই বাঁকানো পথকেই ভবনের নকশায় ফুটিয়ে তুলেছেন। নদী ও আকাশের আদলে তৈরি হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে একটি প্রশান্তির অনুভূতি দেয় ভবনটি।
ভবনটি শুধু একটি সিনেমা হল নয়, এটি ছিল স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ। ভবনটির স্পাইরাল র্যাম্প একে আইকনিক করে তুলেছিল। এটি একটি মাস্টারপিস কাজ ছিল। আল মামুন উর রশিদ বলেন, "র্যাম্পের অনন্য এবং জটিল ডিজাইন বাংলাদেশে ইউনিক। এখন পর্যন্ত এর মতো আর একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়নি।"
গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য তৈরি এ স্পাইরালটি প্রকৌশলবিদ্যার এক অনন্য উদাহরণ হয়েছে। একে সংরক্ষণ করে আধুনিক কালো কাচ ও আধুনিক আলোকসজ্জার মাধ্যমে এর সৌন্দর্য আরও বাড়ানো হয়েছে। ভবনটির এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশই এ স্পাইরাল র্যাম্পটি।
প্রতিটি তলা থেকে দুই হাজার বর্গফুট জায়গা সরিয়ে স্থপতিরা একটি আঙিনা তৈরি করেছেন এবং সেখানে একটি ঝর্ণা বসিয়েছেন। এ খালি অংশের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে ভবনটিকে আলোকিত করে।
জায়গাটি একসময় অন্ধকার ও সংকুচিত ছিল। সেই জায়গাটিই এখন জীবন্ত, প্রাণবন্ত যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। নিচতলার পানির ফোয়ারাটি ভবনটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
ইতিহাস এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন
বাইরের স্তম্ভ এবং অভ্যন্তরের নকশা একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গেছে। অফিস স্পেসটি সজ্জিত হয়েছে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাঁচামাল এবং উচ্চমানের আমদানিকৃত উপকরণের মিশ্রণে। দেওয়ালটি মার্বেল পাথরের দ্বারা সজ্জিত। একই সঙ্গে এটি মাটির দেওয়ালের মতোও অনুভূতি দেয়।
প্রকল্পের পুরো সময়ে, দলটি ইতিহাস এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন সৃষ্টির চেষ্টায় ছিল। দেয়াল নকশায় ব্যবহৃত হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী ইট, যা ফরিদপুরের ২০০ বছরের পুরোনো একটি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা স্পেসে একটি গ্রামীণ আবেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশি সংস্কৃতির কালচারাল স্মারকগুলো, যেমন লাঙল (কৃষি যন্ত্র), ঢেঁকি (প্রথাগত ধান ভাঙার যন্ত্র), হারিকেন ল্যাম্প এবং বাঁশ, ব্যবহার করা হয়েছিল বিল্ডিংয়ের মেঝে নকশায়, যা বাংলাদেশ ইতিহাসের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক ছোঁয়া দিয়েছে।
এমনকি সিনেমা হলগুলোকেও সতর্কতার সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। মূল স্ক্রিনের আকারগুলো একই রাখা হয়েছে। যদিও ভিতরে নতুন সাউন্ড সিস্টেম ও আরামদায়ক আসন সংযুক্ত করা হয়েছে। তারপরও সামগ্রিক ভাবে এর মধ্যে ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা ছিল।
মামুন বলেন, "আমরা ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইনি। আমরা ঐতিহ্য ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সেটি আরও উন্নত করতে চেয়েছি।"
সনি স্কয়ারের অভ্যন্তরীণ ডিজাইনটি প্রাকৃতিক উপাদান এবং আধুনিক নান্দনিকতার নিখুঁত মিশ্রণ। এর আধুনিক বৈশিষ্ট্যগুলোর পাশাপাশি, সনি স্কয়ারে প্রকৃতিরও ছোঁয়া রয়েছে।
প্রাকৃতিক রঙের সুরক্ষিত রূপকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য মেঝেটি নিরপেক্ষ রাখা হয়েছে। প্রকৃতির মতো, রঙের মধ্যে হায়ারার্কি অনুসরণ করা হয়েছে, যেখানে সোজা-সোজা আধুনিক আসবাবের কমলা রঙের স্পর্শ দেখা যাচ্ছে। আর শেষমেশ, প্রকৃতিকে কাছাকাছি আনার জন্য, কলামগুলো কালো গ্লাস প্যানেল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। যাতে ভেতর থেকে বাইরের গাছগুলো দেখা যায়। আর চারপাশে এমনভাবে গাছগুলো আচ্ছাদিত হয়ে আছে যে মনে হবে যেন অরণ্যের মাঝে বসে আছি।
আঙিনা, কাচের প্যানেলযুক্ত কলামের সঙ্গে যা আশেপাশের সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য শহরের যান্ত্রিকতার মধ্যে খানিকটা প্রকৃতির সান্নিধ্য দেয়। দেওয়াল ও মেঝের মাটির রঙের, কমলা রঙের আসবাবের স্পর্শে সজ্জিত, বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ব্যস্ততার মধ্যে একটি উষ্ণতা এবং প্রশান্তির অনুভূতি দেয়।
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে সিনেমা হল ও শপিং কমপ্লেক্সে রূপান্তর হওয়া সনি স্কয়ারের গল্পটি যেন সংযুক্তি ও উদ্ভাবনের গল্প। এটি একটি স্মরণিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
সনি স্কয়ারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে আমরা একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা করছি। সিনেমা হলগুলোর পুরোনো আকর্ষণ থেকে শুরু করে সজ্জায় ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী উপকরণ, প্রতিটি কোণ যেন গল্প বলে। দর্শকরা শুধু বিনোদিত হন না, তারা সমৃদ্ধ হন, একটি এমন জায়গার অভিজ্ঞতা লাভ করেন যেখানে ঐতিহ্য এবং উদ্ভাবন একত্রিত হয়েছে।
মামুন বলেন, "সনি স্কয়ার শুধু একটি ভবন না। এটি একটি সাক্ষ্য। আমরা যখন ইতিহাসকে সম্মান করি এবং ভবিষ্যতকে গ্রহণ করি এটি তার অনন্য উদাহরণ।"