মদ, তেল, কমলার জুস: ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে যেসব অস্ত্র নিয়ে লড়তে পারে কানাডা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন কানাডার পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলেন, তখনই ধারণা করা হয়েছিল—কানাডা দ্রুত ও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
শনিবার ট্রাম্প ঘোষণা করেন, কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। তবে 'জ্বালানি সম্পদ'-এর ক্ষেত্রে এই হার হবে ১০ শতাংশ।
এর আগেরদিন কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন: 'আমরা এটা চাই না। কিন্তু তিনি যদি পদক্ষেপ নেন, আমরাও পাল্টা ব্যবস্থা নেব।'
শুল্ক আরোপ ট্রাম্পের অর্থনৈতিক ভিশনের প্রধান অংশ। তার বিশ্বাস, শুল্ক বসালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাঙা হবে, কর্মসংস্থান সুরক্ষিত হবে এবং কর রাজস্ব বাড়বে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত কানাডার অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ধাক্কা হয়ে আসতে পারে—এবং একইসঙ্গে মার্কিনীদের জন্যও পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে।
টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ট্রুডো বলেন, 'আমি মিঠে কথায় বলব না—আগামী দিন ও সপ্তাহ আমাদের জন্য কঠিন হতে পারে।'
কানাডা সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইতিমধ্যেই ১ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারেরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্তের নিরাপত্তা জোরদার করতে—যা ট্রাম্পের অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। অনেকে মনে করছেন, শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প আসলে আলোচনায় সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন।
ট্রুডো বলেছেন, সব ধরনের বিকল্প এখনও হাতে আছে। ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে কানাডার লড়াইয়ের চারটি সম্ভাব্য হাতিয়ারের কথা আলোচনা করা হলো এখানে।
১. নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ
কানাডা কিন্তু এর আগেও ট্রাম্পের সঙ্গে 'শুল্কযুদ্ধে' মুখোমুখি হয়েছে।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে কানাডিয়ান অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ১০ শতাংশ এবং স্টিলের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিলেন।
জবাবে কানাডাও কৌশলগতভাবে নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, সরাসরি ট্রাম্প ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের বার্তা দেওয়া।
ফ্লোরিডার কমলার জুস, টেনেসি ও কেন্টাকির হুইস্কি ও বুরবনের ওপর শুল্ক বসায় কানাডা। কেন্টাকি হলো সেই সময়ের রিপাবলিকান সিনেট নেতা মিচ ম্যাককনেলের রাজ্য।
অবশ্য এক বছরের মধ্যেই দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে এসব শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়।
কানাডার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ট্রাম্প নতুন করে শুল্ক বসালে কানাডার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও হবে লক্ষ্যভিত্তিক।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকার ১৭ শতাংশ রপ্তানি পণ্য যায় কানাডায়, আর কানাডার ৭৫ শতাংশ রপ্তানি পণ্য যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কানাডার অর্থনীতিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আর বাণিজ্যে এই বিশাল অসমতার কারণেই কানাডা সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক বসানোর পথ বেছে নেয়—যাতে প্রতিশোধও নেওয়া যায়, আবার নিজের জনগণের ওপরও তেমন প্রভাব না পড়ে। কারণ ব্যাপকভাবে শুল্ক বসালে তৎক্ষণাৎ পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এ কারণেই সরকার 'কানাডার পণ্য কিনুন' প্রচারাভিযানকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে পাল্টা শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কমানো যায়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হতে পারে। ট্রাম্পের যেহেতু তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, তাই রাজনৈতিকভাবেও তিনি আগের মতো চাপ অনুভব করবেন না।
২. ডলারের সমপরিমাণ শুল্ক
প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রথম বাণিজ্য যুদ্ধের সময় কানাডা আরেকটি কৌশল নিয়েছিল—ডলারের সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ।
যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কানাডার অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাতের ওপর শুল্ক বসিয়েছিল, ঠিক একই হারে মার্কিন পণ্যের ওপরও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে কানাডা। ওই সময় মোট শুল্কের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬.৬ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার।
এবার কানাডা আরও বিস্তৃত পরিসরে এরকম শুল্ক বসাতে পারে। কর্মকর্তাদের বরাতে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, প্রথম দফায় প্রায় ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্যকে শুল্কের আওতায় আনা হতে পারে।
এই আওতা আরও বাড়িয়ে ১১০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার পর্যন্ত নেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
তবে ট্রাম্পের শুল্ক যত বিস্তৃত হবে, কানাডাও তত বেশি মার্কিন পণ্যের ওপর কর বসাতে পারে।
তবে কানাডার সবাই ডলারের সমপরিমাণ শুল্কের পক্ষে নয়। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ প্রদেশ সাসকাচেওয়ানের নেতা স্কট মো বলেন, মার্কিন পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ 'এদেশকে ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে'।
অর্থনীতিবিদ জুলিয়ান কারাগেসিয়ান বলেন, মার্কিন শুল্কের কারণে কানাডায় মন্দা দেখা দিতে পারে। আর কানাডা যদি ডলারে সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করে, তাহলে মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হবে।
এতে 'স্ট্যাগফ্লেশন' (যখন বেকারত্ব বাড়ে কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমে না) দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
বাণিজ্য বিশ্লেষক পিটার ক্লার্ক বলেন, কানাডা যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, রাজনীতিই মূল চালিকা শক্তি হবে। জনমত জরিপ অনুযায়ী, বেশিরভাগ কানাডিয়ান পাল্টা পদক্ষেপের পক্ষে। আর অনেক কানাডিয়ান ব্যবসায়ী নেতাও লক্ষ্যভিত্তিক ও ডলারের সমপরিমাণ শুল্ককে আরোপ চান।
ক্লার্ক বলেন, জনসমর্থন বাড়তে পারে, এই আশায় রাজনীতিবিদরা আরও কড়া প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হতে পারেন।
৩. জ্বালানি
কানাডার হাতে থাকা সবচেয়ে বড় অস্ত্রের একটি হলো জ্বালানি।
নিউইয়র্ক, মেইন ও ভারমন্টের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মার্কিন রাজ্যগুলো কানাডার কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও ম্যানিটোবা।
কানাডার সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট ৩০টি মার্কিন রাজ্য কোনো-না-কোনোভাবে কানাডার বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।
শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী দেশও কানাডা। মার্কিন আমদানির ৬০ শতাংশের বেশি জোগান আসে কানাডা থেকে।
অন্টারিওর সরকারপ্রধান ডগ ফোর্ড ইঙ্গিত দিয়েছেন, কানাডা যদি মার্কিনীদের জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
শুক্রবার ট্রাম্প বলেছেন, কানাডার তেলের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। তবে পাল্টা জবাব হিসেবে কানাডার হাতে এখনও জ্বালানির ওপর বিধিনিষেধ বা নতুন কর বসানোর মতো বিকল্প রয়েছে।
কারাগেসিয়ান বলেন, জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তা হবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। 'কারণ ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারে বারবার জ্বালানির দাম দ্রুত কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।'
তবে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে তেলসমৃদ্ধ আলবার্টা প্রদেশের জন্য। আলবার্টা সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর কোনো শুল্ক বসাতে রাজি নয়। কারণ এতে প্রদেশের অর্থনীতিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৪. মার্কিন মদ নিষিদ্ধ করা—অথবা কোনো প্রতিক্রিয়াই না দেখানো
কানাডায় আরও কিছু ব্যবস্থার প্রস্তাব বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
ডগ ফোর্ড বলেছেন, অন্টারিও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত অ্যালকোহল পণ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
আরেকটি বিকল্প হলো এই মুহূর্তে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা না নেওয়া।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কানাডার শীর্ষ কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় করছেন, যাতে প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র কোনো শুল্ক আরোপ না করে।
বুধবার কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং স্পষ্ট বার্তা দেন—শুল্ক আরোপ উভয় দেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
এছাড়া কানাডা ইতোমধ্যে একটি সহায়তা প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা করছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য—ঠিক যেমনটা কোভিড মহামারির সময় করা হয়েছিল।
অনেকে বলছেন, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে কানাডার উচিত বাণিজ্য বহুমুখীকরণ ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর মনোযোগ দেওয়া।
কারাগেসিয়ান বলেন, 'আমরা প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ দেশ। আমাদের উচিত এই শুল্ক পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নতুন বাজার খোঁজা।'