খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কি প্রকৃতপক্ষে সম্ভব?
ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাধার বাউনিয়া খাল মিরপুর-১৩ থেকে শুরু হয়ে উত্তরা তুরাগ নদীতে মিশেছে। একসময় প্রবাহমান এ খাল এখন দখল ও দূষণের শিকার হয়ে কার্যত নর্দমায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে খালের ওপর গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বস্তি, গ্যারেজ ও মসজিদ। এমনকি খালের মধ্যে ময়লা ফেলে দ্বীপের মতো বস্তিও তৈরি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে, যা জনজীবনকে চরম দুর্ভোগে ফেলে।
আজ রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) মিরপুর-১৩ থেকে বাউনিয়া খাল উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত, জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে ৬টি খাল থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও পুনঃখনন করা হবে।
ডিএনসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি ব্লু নেটওয়ার্ক প্রকল্পের অংশ, যা শহরের জলাধারগুলোর পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করবে বাস্তবায়ন ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর।
উচ্ছেদ কতটা সম্ভব?
বাউনিয়া খালটির বড় অংশ ডিএনসিসির আওতাধীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দখলমুক্ত করা গেলে মিরপুর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসবে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাউজিং সোসাইটি, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্বের কারণে খাল উদ্ধার কার্যক্রম কঠিন হবে। এমনকি ডিএনসিসি নিজেও খালের কিছু অংশ ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করেছে।
ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও তাদের বিভিন্ন স্থাপনা ও পাম্প হাউজ তৈরি করেছে খালটির জায়গা দখল করে। এমনকি এ খালের বেশকিছু স্থানে ইজারাও দিয়েছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।
ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এর আগেও একাধিক মেয়র খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন মহলের চাপে কার্যক্রম থেমে যায়।
তিনি আরও বলেন, 'দখলদারদের বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, ফলে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।'
দখলদারদের অবস্থান ও প্রভাব
বাউনিয়া খালের মাঝেই একদল দখলদার ঘর নির্মাণ করে তা ভাড়া দিয়েছে। খালের পাড়ে প্রশস্ত রাস্তা, স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও বহুতল ভবন রয়েছে। ভাষানটেক এলাকায় খালের কিছু অংশ কালভার্টের মাধ্যমে সংকুচিত করে আশপাশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, উচ্ছেদ কার্যক্রম সাধারণত বস্তিবাসীদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়, যেখানে বড় দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
স্থানীয় বাসিন্দা ফয়জুল বেপারী বলেন, বড় বড় দখলদারদের কিছু হয় না, শুধু বস্তিবাসীদের ঘর ভাঙা হয়। আগেও এমন হয়েছে, এবারও তা-ই হবে বলে মনে করেন তিনি।
'আমরা বস্তিতে থাকি—জানি সেটা অবৈধ জায়গা—কিন্তু বড় ভবন না ভেঙে আমাদের মতো গরীবের ঘরগুলোই ভাঙতে পারবে। এর আগেও মেয়ররা আসত, বস্তির কিছু ঘর ভেঙে চলে যেত। কিন্তু বাকি বড় বড় দখলদারদের কিছু হতো না,' বলেন তিনি।
ভাষানটেকের ষাটোর্ধ্ব আজিজ বলেন, 'খাল দখল করেছে বড় বড় হাউজিং ও সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারকে ম্যানেজ করে অনেকেই বৈধ কাগজপত্র তৈরি করেছে।'
সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিবাচক প্রত্যাশার দিকে ইঙ্গিত করে পরিবেশকর্মী নয়ন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন করেছেন, 'এখন ঢাকার খালগুলো পুনরুদ্ধার করা না হলে আর কখন?'
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম তার মেয়াদকালে বিভিন্ন সময়ে খাল উদ্ধার কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি নগরবাসীকে নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়ে খালগুলো পুনরুদ্ধারের আশ্বাসও দিয়েছিলেন।
গত সরকারের আমলে একাধিকবার মিরপুরের বিভিন্ন খালে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও বাস্তবে কোনো খাল পুরোপুরি দখল ও দূষণমুক্ত হয়নি। কিছু এলাকায় লোক দেখানো ভবন ভাঙার পরও কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
আতিকুল ইসলাম একাধিকবার স্বীকার করেছিলেন যে, দখলদার এবং ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
২০২৪ সালে খাল দখল নিয়ে তিনি টিবিএসকে বলেছিলেন, 'খাল দখলমুক্ত করতে গেলেই আমাকে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের চক্ষুশূল হতে হয়। তারপরও যতটা সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
বর্তমান পরিস্থিতিও একইরকম। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, খালগুলো পুরোপুরি দখলমুক্ত করা আদৌ সম্ভব হবে কি না।
ব্লু নেটওয়ার্ক উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ঢাকায় ব্লু নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা ১৯টি খাল সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম ধাপে বাউনিয়া, কড়াইল, রূপনগর, বেগুনবাড়ি, মান্ডা ও কালুনগর খালের দখল ও দূষণমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে খাল সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে খালের সীমানা নির্ধারণ, খাল পরিস্কার, পাড় সংরক্ষণসহ ব্লু নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, খালগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। খালের পাড়ে বর্জ্য ফেলার স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, 'একটা বিহিত করতে হবে যাতে খালে কেউ ময়লা ফেলতে না পারেন। আর এজন্য স্থানীয়দেরকে দিয়ে আমরা একটা কমিটি করে দেব, দুই কিলোমিটার পর পর একটা কমিটি থাকবে, তারা এটি মনিটর করবে।'
খালের পাড়ে সবুজ ফিরিয়ে আনার আলাদা পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। 'খালপাড়ে আমরা চাষাবাদ করতে পারি কি না, সে পরিকল্পনাও রয়েছে। খালের মধ্যে মাছ আনা যায় কি না তারও চেষ্টা করা হবে।'
এ বছরের মধ্যেই ১৯টি খালের দখল ও দূষণমুক্তকরণের কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।
ডিএনসিসির প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, 'ঢাকা শহরে ব্লু নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ডিএনসিসির আওতাধীন খালের দখল ও দূষণমুক্ত করতে আমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।'