বিশ্বের চিকিৎসকরা কি আরেকটি সংক্রমণের জোয়ার থেকে বাঁচতে পারবেন?
কোভিড-১৯ এমন একটি ব্যাধি যার নিরাময় চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার হয়নি। এই অবস্থায় গত জুন-জুলাইয়ে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেসময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন অনেক নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক। চিকিৎসা দিতে কারো কারো অনীহার কথা যেমন জানা গেছে, ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীদের অজস্র আত্মত্যাগের ঘটনাও এসেছে গণমাধ্যমের আলোচনায়।
সম্মুখভাগের এসব যোদ্ধা দিনের পর দিন নিম্নমানের সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে বা কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়াই আক্রান্তের সেবা করেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে নিজ সাধ্যের পুরোটাই উজাড় করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা। দায়িত্বের ভার সামলাতে দূরে থেকেছেন পরিবার-পরিজন থেকেও।
কিন্তু, পৃথিবীজুড়ে আবারও দেখা দিয়েছে সংক্রমণের দ্বিতীয় জোয়ার। প্রশ্ন উঠছে, নতুন হুমকি প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুতির প্রসঙ্গে।
এক্ষত্রে প্রথমেই বলা যাক- করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে প্রাণহানি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কথা। সেদেশে প্রথমদিকে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল নিউইয়র্ক শহরে। তারপর পরিস্থিতির অবনতি হয়। সংক্রমণ বেড়ে চলায় রোগীর চাপে দিশেহারা সময় কাটে চিকিৎসকদের। সঙ্গে জীবাণুর হুমকি মোকাবিলার ঝুঁকি তো ছিলই, মানসিক ভাবেও যা অনেককে বিপর্যস্ত করে।
এমন অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছেন ৩৯ বছরের ইমার্জেন্সি রূম ফিজিশিয়ান জেন কিম। গত এপ্রিলের ওই সময়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ রোগীর ভিড় সামলেছেন। তার মধ্যেই শুনেছেন পরিবারের সদস্যের মতো আপনজন হয়ে ওঠা চার সহকর্মীর মৃত্যু সংবাদ। প্রথম তিনজন জীবাণুর সংক্রমণেই মারা যান। আর একজন মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেছিলেন।
কান্না বিজড়িত কণ্ঠে কম জানান, ''প্রতিটি মৃত্যু আপনাকে ধাক্কা দেয়। চিকিৎসক হিসেবে; মানুষ ও সহকর্মী হিসেবেও। খুব কাছের প্রাণবন্ত কারো বিদায় নেওয়ার কথা আপনি মেনে নিতে পারেন না সহজে। তাই আমি মৃত্যুর ঘটনাগুলো জেনে চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। দমবন্ধ হয়ে আসছিল যেন।''
ওই শোক কাটিয়ে উঠতে এখন বন্ধু-পরিজন আর মানসিক থেরাপির সাহায্য নিচ্ছেন কিম।
তার জন্য স্বস্তির একমাত্র কারণ এটাই যে, চিকিৎসকরা এখন সেই প্রথমদিকের অনিশ্চিত সময়ের তুলনায় কীভাবে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা করতে হবে, তার সম্পর্কে অনেক ভালো জানেন।
কিন্তু, উৎকণ্ঠাও কম নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আবার বানের মতোই দেখা দিয়েছে সংক্রমণের নতুন জোয়ার। রোগীদের বিশাল ভিড়ে আবারও চিকিৎসকেরা দিশেহারা হয়ে পড়বেন, এমন আশঙ্কাই করছেন কিম।
তিনি বলেন, ''আমার খুব ভয় হচ্ছে। কারণ আমি জানি শারীরিক, মানসিক এবং স্নায়বিকভাবে এই চাপ মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রস্তুত নই। নিজের কথা অন্তত পরিষ্কারভাবে বলতে পারি। আমি মোটেই প্রস্তুত নই।''
মহামারি যখন বিশ্বব্যাপী বাড়ন্ত তখন শুধু কিম নন, তার মতো অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবা কর্মী হাঁফিয়ে উঠেছেন জীবনের ঝুঁকি নিতে নিতে। থেকে থেকে সংক্রমণের জোয়ার তাদের সকল দিক থেকেই পরিশ্রান্ত করেছে। তাছাড়া, জীবন বিপন্ন হওয়ার সংখ্যাও তো কম নয়।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রে-ই এপর্যন্ত দুই লাখ ১৮ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমণের শিকার হন। মারা যান কমপক্ষে ৮ শতাধিক। দেশটির কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা – সিডিসির মতে মোট জনসংখ্যা সংক্রমণ হার ৩.৪% হলেও স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্ষেত্রে তা ১২%!
শুধু আক্রান্ত হওয়া নয়, অন্যান্য দিকগুলোও অবহেলা করার মতো নয়। আটলান্টিকের অপর পাড়ে যুক্তরাজ্যের ৪০ শতাংশ চিকিৎসকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের এক জরিপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
তাই সংক্রমণ যখন তুঙ্গে তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিপুল পরিমাণ স্বাস্থ্য কর্মী তা মোকাবিলায় শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত নন।
চিকিৎসকদের পরিশ্রান্ত দশা থেকে মুক্ত নয় ইতালিও। সেখানে আবার অপ-প্রচারণা এবং চিকিৎসক বিদ্বেষ লাভ করেছে নতুন মাত্রা।
তুরিনের ভিট্টোরিয়া হাসপাতালের ৪৯ বছর বয়সী অ্যানাস্থোলজিস্ট সিলভিয়া জর্জিস বলেন, সংক্রমণের প্রথম জোয়ারের সময় উত্তেজনা নিয়েই ডাক্তাররা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু, তারা পুনরায় সংক্রমণ হার বেড়ে চলার পেছনে নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ। মানুষের উদাসীনতাও তাদের আঘাত করেছে। লকডাউন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর হলেও জীবন বাঁচানোর স্বার্থে অনেক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ সেই উদ্যোগ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাদের মিথ্যেবাদী দাবি করে অনেকেই কটাক্ষ করেছেন। সামাজিক গণমাধ্যমেও আমাদের নিয়ে মিথ্যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মহামারির প্রথমদিকে আমরাই ছিলাম জনগণের নায়ক। বাড়িতে অনেক মজার খাবার আর পিৎজা উপহার পাঠাতো মানুষ। আর সেই আমরাই এখন কিনা জনশত্রুতে! পরিণত হয়েছি। কেউ কেউ আমাদের খুনি উপাধিও দিচ্ছে।''
মিশিগানের মাস্কেগন শহরে অবস্থিত মার্সি হেলথ হসপিটালের নিউরোলজিস্ট ডা. প্যাট্রিক পাভোস্কি'র শঙ্কা চিকিৎসকদের মনোবল দুর্বল হওয়া এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও রোগীর সঠিক চিকিৎসা ব্যাহত হবে।
তিনি জানান, তার নিজেরও বিশ্রাম দরকার। কিন্তু, ইতোমধ্যেই তার বেশকিছু সহকর্মী সার্স কোভ-২ ভাইরাসে পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন, তাই বাধ্য হয়েই তাকে কাজ করে যেতে হচ্ছে।
''আমিও যদি সংক্রমিত হই, তাহলে আমার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কীভাবে মানুষকে সেবা দিবে- তা আমার জানা নেই,'' পাভোস্কি জানান।
সম্প্রতি ক্লান্তির কারণে তিনি একজন রোগীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ই সেখান থেকে বিরক্ত হয়ে উঠে চলে আসেন। পরবর্তীতে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে অবশ্য তিনি রোগীর কাছে ফিরে এসেছিলেন।
ওই ঘটনার ব্যাখ্যায় ৩৭ বছরের এ যুবা চিকিৎসক বলেন, ''সত্যি বলছি আমি ভীষণ ক্লান্ত। মাঝে মাঝে হাসপাতালে নিজের কক্ষেই আপনা-আপনি ঘুমিয়ে পড়ি। তখন সামনে থাকা রোগী কী বলছেন- তার কিছুই শুনতে পারি না।''
অন্যান্যদের মতো, সংক্রমণ এড়াতে মানুষের উদাসীনতা নিয়ে পাভোস্কিও ভীষণ হতাশ ও ক্ষুদ্ধ। এরমধ্যেই সামাজিক গণমাধ্যমে মানুষের মাস্ক ছাড়া ছবি পোস্টের বিকৃত তাড়না, তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। আসন্ন থ্যাংকসগিভিং উৎসব ঘিরে মানুষ নৈশভোজের আয়োজন করছে, এমন সব কথা জেনেও তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
নিউইয়র্ক শহরের সেই ডাক্তার কিম জানান, এমন মানুষদের বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু, তাদের কারণেই আজকের এই দশা। তারা অবহেলা না করলে মহামারি এপর্যায়ে হয়তো কখনোই পৌঁছাতো না। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একটি অংশ মহামারির বিপদকে উস্কে দেওয়ার কারণেও তিনি ভীষণ হতাশ।
কিছুদিন আগে তাকে এক ব্যক্তি স্মার্টফোনে একটি ভুয়া সংবাদ পাঠান। সেখানে নিউইয়র্কে প্রথম সংক্রমণে বিপুল প্রাণহানির ঘটনাকে সাজানো নাটক বলা হয়েছিল। সঙ্গেসঙ্গেই রাগে-ক্ষোভে দেওয়ালে নিজের ফোন ছুরে ভেঙ্গে ফেলেন কিম।
তার মতে, ''মানুষ কীভাবে এত উদাসীন ও গোঁয়ার হতে পারে। সবকিছু আমাদের চোখের সামনেই হচ্ছে। কীভাবে তারা এমন আজগুবি সংবাদ নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে এবং তা ছড়িয়ে দিতে পারে- আমি সেটা কিছুতেই বুঝতে পারি না।''
- সূত্র: টাইম