প্রতারণার জন্য ছবি: এদের কেউ বাস্তবে নেই!
মানুষের নকল পরিচয়, ছবি ব্যবহারের কথা তো আমরা অহরহ শুনে থাকি। তবে এধরণের নকল পরিচয় বা ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অন্য কোনো মানুষেরই ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, হুবহু মানুষের মতো দেখতে ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই ছবির ব্যক্তির আসলে বাস্তবে অস্তিত্ত্বই নেই!
এমনকি এধরণের ছবি বিক্রি সংক্রান্ত ব্যবসাও দাঁড়িয়ে গেছে। Generated.Photos ওয়য়েবসাইটে ২.৯৯ ডলার মূল্যে একজন মানুষের ছবি এবং ১০০০ ডলারে এক হাজার জন আলাদা মানুষের ছবিও কেনা যায় এখন। এবং এদের কারোই বাস্তবে অস্তিত্ত্ব নেই, একেবারেই কম্পিউটারের কল্পনা।
নিজের ইচ্ছামত লিঙ্গ, বয়স, জাতিসত্ত্বা সবকিছুই নির্ধারণ করে দেয়া সম্ভব। এই নকল মানুষের অ্যানিমেশন ছবিও বানিয়ে দেয়ার কাজ করে Rosebud.AI এর মতো ওয়েবসাইট। শুধু তাই নয়, অস্তিত্ত্বহীন এই মানুষদের কথাও শুনতে পাবেন উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে।
তবে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অসাধু উদ্দেশ্যেও এসব ছবির ব্যবহার হয় অহরহ। আকর্ষণীয় ছবি ব্যবহার করে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজে, নকল পরিচয়-ছবি ব্যবহার করে ডানপন্থী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে বা অনলাইনে নকল পরিচয় ব্যবহার করে হ্যারাজমেন্টের জন্যও এর অপব্যবহার হতে পারে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমে (এআই) প্রতিটি মানুষের চেহারাই গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করে তৈরি হয়। বিভিন্ন হিসাব ব্যবহার করে চোখের আকার আকৃতি বা যে কোনো বৈশিষ্ট্য বদলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন চেহারার মানুষের ছবি তৈরি হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (জিএএন) নামের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে এধরণের নকল ছবি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তবে কম্পিউটার প্রোগ্রাম যে একদমই নিজ থেকে শুধুমাত্র গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করে ছবিগুলো তৈরি করছে ব্যাপারটি এমনও নয়। কম্পিউটার প্রোগ্রামে বেশকিছু আসল মানুষের ছবি দেয়ার পর ছবিগুলো বিশ্লেষণ করেই নতুন ছবি তৈরি করে।
নতুন ছবি তৈরি করার সময় যে একটি মাত্র ছবি থেকেই আরেকটি নতুন ছবি তৈরি হয় এমনও নয়। ফলে নতুন তৈরি এই ছবিগুলো আসল ছবিগুলো থেকেও দেখতে আরও জীবন্ত এবং স্বতন্ত্র মনে হয়। যে গতিতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে একটি নকল ছবিরই সম্পূর্ণ সমগ্রও তৈরি করা সম্ভব হবে। একজন মানুষের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে একাধিক মানুষের সাথে ছবি দেখে বোঝার কোনো উপায় থাকবে না যে বাস্তবে মানুষটির অস্তিত্ত্বই নেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও ভুল তথ্য সংক্রান্ত গবেষক ক্যামিলে ফ্রাঙ্কোইস জানান, '২০১৪ সালে যখন প্রথম এই প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়, তখনকার ছবিগুলো দেখার মতোই ছিলনা। দেখতে কার্টুন চরিত্রের মতো মনে হতো। এখনকার ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় কতো দ্রুত প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে আসল নকল নির্ধারণের কাজ আরও কঠিন হবে।'
মানুষের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের প্রযুক্তিরও অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। স্মার্টফোন খুলতে ফেস আনলক প্রযুক্তি, ফটো সফটওয়্যারের মাধ্যমে হাজার হাজার ছবি থেকে নির্দিষ্ট কোনো ছবি খুঁজে বের করা এসব প্রযুক্তি নকল ছবি তৈরির প্রযুক্তি উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে।
তবে অন্যান্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মতো ফেসিয়াল রেকগনিশন প্রযুক্তিও শতভাগ নিখুঁত নয়। এর কারণও অবশ্য মানুষের পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ, কারণ মানুষই এসব প্রযুক্তি তৈরির প্রাথমিক কাজগুলো করে, তথ্য দেয়। ২০১৫ সালে গুগলের ইমেজ ডিটেকশন প্রযুক্তি দুইজন কৃষনাঙ্গ ব্যক্তিকে গরিলা হিসেবে চিহ্নিত করে। এর কারণ হয়তোবা তাদের সার্ভারে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ছবির চেয়ে গরিলার ছবিই বেশি ছিল। এসব প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্যামেরাও অনেক সময় সকল বর্ণের মানুষকে চিহ্নিত করার কাজে সমান দক্ষতা দেখাতে পারেনা।
এর আরও পরিণতিও ভয়াবহ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে রবার্ট উইলিয়ামস নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে, পরবর্তীতে জানা যায় এর কারণ ছিল চিহ্নিত করার প্রযুক্তির ভুল তথ্য।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলতে পারে, দিনশেষে মানুষের মতো প্রযুক্তিও ভুল করতে পারে। কেননা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করবে, কী কী তথ্য দেয়া হবে তা সবই মানুষই নির্ধারণ করে। পূর্ববর্তী বিচারকদের সিদ্ধান্ত এবং তথ্য দিয়েই অপরাধ শনাক্তকরণের প্রযুক্তি তৈরি করা হয়। একারণে তাদের কোনো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ প্রযুক্তির মধ্যেও থেকে যেতে পারে।
এই ছবিগুলোও খেয়াল করে দেখলে অনেক অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো ছবিতে ব্যবহৃত একজোড়া অলঙ্কারের দুটির মধ্যে কিছুটা বৈসাদৃশ্য দেখা যাবে।
গাণতিক সংখ্যা ব্যবহার করে ছবিগুলো তৈরি করায় কোনো ছবির চোখজোড়া হয়তো একই সমান্তরালে অবস্থিত, দুই চোখের মণি একই দূরত্বে অবস্থিত এমনও হতে পারে। অনেক ছবিতেই চশমার ব্যবহার হয়, চশমার দুইপাশেও কিছুটা বৈসাদৃশ্য দেখা যেতে পারে।
তবে প্রযুক্তির ভুল ও অসঙ্গতিগুলো প্রায়শই মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্মিলিত কাজের ক্ষেত্রে মানুষ নির্দ্বিধায় প্রযুক্তির ভুল অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষের চেহারা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে এমন অহরহ ভুলের উদাহরণ আছে। জিপিএস সিস্টেমের প্রথম দিকে গাড়ি চালকরা অনেক সময় ডিভাইসের নির্দেশনা মেনে ভুল পথে চলে গেছে। এমনকি পথ ভুলে কোনো নির্জন বন, পাহাড়ের চূড়া বা পরিত্যক্ত জলাশয়ের দিকেও চলে গেছে।
এর কারণ হতে পারে মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব, কিংবা এর ঠিক উল্টো। মানুষের তৈরি প্রযুক্তি একদম নির্ভুল হবে এমন আত্মবিশ্বাস থেকেও এধরণের ব্যাপার ঘটতে পারে।
গুগল সহ অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে আমরা নিমিষেই পৃথিবীর বিচিত্র জ্ঞানের ভান্ডারের সন্ধান পেয়ে যাই। ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও আমাদের নিজস্ব পছন্দ, পরিবেশ অনুযায়ী আমাদের টাইমলাইনে বিভিন্ন তথ্য দেখায়। গাড়িতে সেলফ ড্রাইভিং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা নিজেদের নিরাপত্তার ভারই প্রযুক্তির হাতে তুলে দেই। বলা যায়, চোখ বন্ধ করেই আমরা প্রযুক্তিকে বিশ্বাস করি, কিন্তু দিনশেষে প্রযুক্তিরও ভুল হতে পারে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস