৪৬ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ এশিয়ার শীর্ষ ২০ ধনী পরিবারের নিয়ন্ত্রণে
আল্পস পর্বতমালার সুইজারল্যান্ড অংশে অবস্থিত লুকর্ন হ্রদ। সুর্যের আলো এই জলরাশির বুকে প্রতিফলিত হয়ে মোহিত করে পর্যটকদের। আর হ্রদের ধারেই এক বিলাসবহুল অবকাশযাপন কেন্দ্র। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতেই সেখানে আসে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ এক ধনী পরিবার।
সেই পরিবারটি হচ্ছে এশিয়ায় সেরা ধনী মুকেশ আম্বানির। সেপ্টেম্বরে তিনি স্ত্রী, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ও তাদের জীবনসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে বুইরর্গেনস্টক নামের এই রিসোর্টে আসেন। যে মুহূর্তে ভ্রমণ তা কিন্তু আম্বানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অবকাশ যাপন উত্তরাধিকার নির্ণয়ের প্রক্রিয়া কিনা তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলেছে।
করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থবির করেছে অনেকাংশে। ভারতের অবস্থাও একই। আর মুম্বাইয়ে আম্বানি পরিবার অ্যান্টিলা নামের ২৭তলা যে দালানে বাস করে, সেই এলাকাতেও বাড়ে সংক্রমণ সংখ্যা। এই অবস্থায় নিরাপদে থাকতে সপরিবারে সুইজারল্যান্ডে সময় কাটানো মন্দ উপায় নয়।
তবে এর কয়েক সপ্তাহ আগেই হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা। এসময় ৬৩ বছরের আম্বানি বিশ্বের বৃহত্তম কিছু প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বের চুক্তি করেন। তাদের কাছে বিক্রি করেন রিলায়েন্সের ডিজিটাইল ইউনিটে তার মালিকানার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এরপর তার খুচরা ব্যবসায়ের উদ্যোগে বিনিয়োগ সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়া হয় কয়েকদিন পরই।
অতি-ধনী এই ব্যবসায়ী তার জ্বালানি পরিশোধনাগার কেন্দ্রিক শিল্পগোষ্ঠিকে ধীরে ধরে রূপ দিচ্ছেন অতিকায় প্রযুক্তি উদ্যোগে। তাই বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন জাগছে, এই বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা ভার কে পাবেন?
এনিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি খবর প্রচার করছে। ওই সূত্রে জানা যায়, উত্তরাধিকার নিয়ে মুকেশের পরিকল্পনা, যার আওতায় তার যমজ দুই পুত্র-কন্যা; ইশা ও আকাশ এবং তাদের ছোট ভাই অনন্তকে - সমান প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া হবে।
মুকেশের তিন সন্তানই শীর্ষ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং গত কয়েক বছর থেকেই তারা পারিবারিক ব্যবসার অনেক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সম্পদ আর প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গেসঙ্গেই এই আম্বানিরা এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিত্তের বৈভব প্রদর্শন তো আছেই। তা সে বিয়ে হোক বা অন্য কোনো উৎসবের আয়োজন, তাদের পার্টিতে এখন নিয়মিত থাকে বিয়ন্স বা কোল্ড প্লে'র ক্রিস মার্টিনের সঙ্গীত পরিবেশনা। সঙ্গে হলিউডের বড় তারকাদের জমকালো উপস্থিতি।
ইউরোপ ভ্রমণেও জৌলুসের প্রদর্শন কম হয় না। বুইরর্গেনস্টকে অবকাশ যাপনেও ব্যতিক্রম হয়নি। রিসোর্টটির ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় অবস্থিত রয়্যাল ও প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট ভাড়া নিয়েছিল আম্বানি পরিবার। তাদের ভ্রমণসূচির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে।
এবারের অবকাশ যদি উত্তরাধিকার নির্ণয়ের প্রক্রিয়াই হয়, তাহলে সেটা অনেক বড় ঘটনা হতে চলেছে। কারণ, এর উপরই নির্ভর করছে বছরে ৯ হাজার কোটি ডলার আয়কারী কোম্পানি আর প্রায় এক লাখ ৯৫ হাজার কর্মীর ভবিষ্যৎ।
ব্যবসায় রিলায়েন্সের এতটাই আধিপত্য যে, এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা ধনী হংকংয়ের কোক পরিবার থেকে শীর্ষে থাকা ভারতীয় পরিবারটি দ্বিগুণ ধনী। দক্ষিণ কোরিয়ার লী পরিবারের চাইতে তাদের সম্পদ তিনগুণ বেশি। জাপানের তোরি এবং সাজি গোত্রের চাইতে যা পাঁচগুণ বেশি। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সের সর্বশেষ সংস্করণে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এই তালিকায় স্থান পেয়েছে এশিয়ার সেরা ২০ ধনী পরিবার।
উত্তরাধিকার পরিকল্পনা চলছে কিনা তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন রিলায়েন্সের একজন মুখপাত্র। এই উত্তরাধিকার নির্বাচনকেই ২০২০ সালের ব্লুমবার্গের এশীয় ধনী পরিবারগুলোর র্যাংকিং তৈরির সময় অন্যতম প্রভাবক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
পারিবারিক ইতিহাস বিবেচনায় আম্বানি পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রিলায়েন্স যার হাত ধরে মহীরুহে অরিনত হয় তিনি ছিলেন ধীরুভাই আম্বানি। ২০০২ সালে কোনো উত্তরাধিকারি ঘোষণা না করেই তিনি স্ট্রোকে মারা যান। এসময় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তার দুই পুত্র- মুকেশ ও অনিল আম্বানি।
এক পর্যায়ে তাদের মা দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব থামাতে হস্তক্ষেপ করেন। ২০০৫ সালে করা ওই সমঝোতার আলোকে তেল শোধনাগার ও পেট্রো-কেমিক্যাল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ পান মুকেশ। আর ফাইন্যান্স, অবকাঠামো নির্মাণ, শক্তি উৎপাদন এবং টেলিকম ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ যায় অনিলের কাছে।
তারপরে অবশ্য ৬১ বছরের অনিলের ব্যবসা ঋণের অর্থে সম্প্রসারিত হয় এবং এক পর্যায়ে দেনা শোধ না করতে পারায় ধীরে ধীরে এর পরিধিও কমতে থাকে। গত কয়েক বছরে আরও দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে অনিলের কপালে। তার ব্যবসার দেনা পরিশোধে এক পর্যায়ে বড় ভাই মুকেশই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে সে যাত্রা ঋণখেলাপের দায়ে কারাবাস থেকে বেঁচে যান অনিল।
ইতোপূর্বে গত ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের একটি আদালতে দায়ের করা এক আর্জিতে অনিল জানান, তার মোট সম্পদমূল্য এখন শূন্য। অথচ ২০০৮ সালের ব্লুমবার্গের হিসাব অনুসারে তার মোট সম্পদ ছিল ৩১শ' কোটি ডলার।
যোগ্য উত্তরাধিকার নিয়ে তাই মুকেশ সতর্ক হবেন তা বলাই-বাহুল্য।
মুকেশ আম্বানির মতো এশিয়ার অন্যান্য ধনী পরিবার তাদের ব্যবসায় বৈচিত্র এনে প্রযুক্তিখাতের দিকে ঝুঁকেছে।
প্রবণতাটি নতুন গতি পেয়েছে মহামারি কারণে। এক্সিকিউটিভ সার্চ ফার্ম এগোন জেহন্ডার- এর পরামর্শক নিল ওয়াটার্স বলেন, ''ব্যবসা ও পুঁজিবাজারে বড় অংশের মালিকানা থাকা পরিবারগুলোর সামনে এখন দুটি উপায় খোলা। হয় তাদের নিজস্ব মালিকানায় থাকা পুঁজি নিরাপদ রাখতে রক্ষ্মণাত্মক কৌশল নিতে হবে। ব্যবসায় আসা নিত্য-নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েই এই চ্যালেঞ্জ যুঝতে হবে। আর দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে তারা আগ্রাসী হতে পারেন।"
প্রযুক্তিখাতের নয়া উদ্যোগকেই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সম্পদ বৃদ্ধির আগ্রাসী কৌশল হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।
অতি-ধনীদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে সম্পদ বৈষম্য নিয়ে ক্রমবর্ধমান জন-অসন্তোষ।
মহামারির মধ্যে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যখন চরমে ঠিক তখনই অতি-ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি মানুষকে ক্ষুদ্ধ করেছে। থাইল্যান্ডে আন্দোলনকারী ছাত্ররা আর্থ-সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস ও প্রকট বৈষম্য নিরসনের দাবি করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আবাসন বাজার হচ্ছে হংকংয়ে। সেখানে বাড়ি ভাড়া অনেকগুণ বেশি। মহামারির কারণে যখন বেকারত্ব ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় তখনও ভাড়া কমেনি। এনিয়েও নতুন বিক্ষোভের আশঙ্কা করছে স্থানীয় প্রশাসন।
আর ভারতে জনসংখ্যার ৭৮ শতাংশ যেখানে পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ্য রাখেন না, যেখানে লকডাউনে কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই না খেয়ে মরেছেন- সেখানে আম্বানিদের জৌলুসের ঠমক অনেককেই ব্যথিত করে বৈকি।
ইতোপূর্বে, গত ১৬ নভেম্বর ব্লুমবার্গ নিউ কোম্পানি ফোরামে অংশ নিয়ে এব্যাপারে গভীর হতাশা প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেজ।
''জীবাণুটি বিস্তার লাভ করার অনেক আগে থেকেই বৈষম্য বাড়ছিল। সমাজের এক শ্রেণি যখন ধনী হচ্ছিল, তখন আরেক শ্রেণির মধ্যে জীবনমান উন্নয়নে সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার যন্ত্রণায় ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেওয়া শুরু করে। ফলে দেশে দেশে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য।''
তিনি আরও বলেন, ''বৈষম্য কমাতে দরকার সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মৌলিক এ শর্ত এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।''
এশিয়ার সম্পদশালী ২০ পরিবার:
এশিয়ার সেরা ধনী পরিবার হচ্ছে আম্বানিরা। তিন প্রজন্মের ব্যবসায়ী পরিবারটির মোট সম্পদ ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
তারপর আছে হংকংয়ের কোক পরিবার। মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুন হাই প্রোপার্টিজ লিমিটেড। ৩ প্রজন্মে সঞ্চিত সম্পদ ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
তৃতীয় স্থান থাইল্যান্ডের চেরোভানানোত পরিবারের। মূল প্রতিষ্ঠান চ্যারিঅন পোপখান্দ গ্রুপ। চার প্রজন্মে সঞ্চিত সম্পদ ৩১.৭ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, সম্পদ ক্রম অনুসারে অন্যান্য পরিবার হচ্ছে; ইন্দোনেশিয়ার হার্তানো, দক্ষিণ কোরিয়ার লী, থাইল্যান্ডের ইয়োভিদইয়া, হংকংয়ের চেং, ভারতের মিস্ত্রি, হংকংয়ের পাও/উ পরিবার-সহ অন্যান্যরা।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ