একা লড়াইয়ে মাশরাফি
'কয় ওভার বোলিং করলেন?' প্রশ্নটা শুনে স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় মুখটা ফিরিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার উল্টো প্রশ্ন, 'আপনি তো সাংবাদিক, গুনে দেখেননি?' প্রশ্নকর্তা দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার আগেই মাশরাফি বলে উঠলেন, 'ছয় ওভার বোলিং করেছি। সঙ্গে টুকটাক ফিটনেসের কাজ।' প্রস্তুতির পালা শেষ, বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক এবার মাঠের লড়াইয়ের অপেক্ষায়।
লটারিতে দল চূড়ান্ত হয়েছে মাশরাফির। জেমকন খুলনার হয়ে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের বাকি অংশটুকুতে মাঠের লড়াইয়ে দেখা যাবে তাকে। তবে এই যে দল পর্যন্ত আসার যে সফরটা, সেটা অন্যান্যবারের চেয়ে একেবারে আলাদা, কঠিনও। করোনাভাইরাসের থাবায় থমকে যাওয়া ক্রিকেট কয়েক মাস আগে মাঠে ফিরলেও মাশরাফির মিশন শুরু হয় অনেক পরে, একা।
লটারিতে জেমকন খুলনায় জায়গা পেতে মাশরাফিকে যে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তা অনেক ক্রিকেটারের দৃষ্টিতেও বন্ধুর পথ। করোনাকালে মাশরাফির ওজন বেড়েছিল অনেকটা। ফিট না থাকায় বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে খেলেননি তিনি। লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ দিয়ে ফেরা, কিন্তু অনুশীলন শুরু করে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে আবারও মাঠের বাইরে মাশরাফি।
কয়েকদিনের বিশ্রামের পর আরও কঠিন লড়াইয়ে নাম লেখান অভিজ্ঞ এই পেসার। ওজন কমিয়ে ফেলেন ১০ কেজির মতো। এরপর গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করেন বোলিং, সাথে ফিটনেসের কাজও। কিন্তু এতেই যথেষ্ট হচ্ছিল না, ফিটনেস পরীক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। কেবল পাস করলেই মিলবে খেলার টিকেট, এমন বার্তা পেয়ে নিজেকে সেভাবেই তৈরি করেছেন তিনি। শনিবার ফিটনেস টেস্টে উতড়ে যাওয়ার পর চূড়ান্ত হয় মাশরাফির দল।
দল পেয়েছেন মাশরাফি, কিন্তু প্রথম ম্যাচ খেলার আগে আর সবার চেয়ে তার তাড়নাই বেশি। তাই সোমবার খুলনার অনুশীলন না থাকলেও দুপুরে মিরপুরের একাডেমি মাঠে ঠিকই হাজির হয়ে যান তিনি। ফাঁকা মাঠে স্ট্রেচিং, রানিংয়ের পর টানা ছয় ওভার বোলিং করেন মাশরাফি। একক অনুশীলন শেষে মাঠ থেকে সোজা সোনারগাঁও হোটেল, দলের সঙ্গে জৈব সুরক্ষা বলয়ে যোগ দিয়েছেন সাবেক ওয়ানডে অধিনায়ক।
কেমন ছিল অনুশীলন? দীর্ঘদিন পর ম্যাচ খেলার আগে বোলিং করে কেমন বুঝতে পারছেন? এমন সব প্রশ্নে গত মঙ্গলবারের কথা মনে করিয়ে দিলেন মাশরাফি, 'বোলিং তো শুরু করেছি গত মঙ্গলবার। প্রথমদিন অনুযায়ী খারাপ ছিল না। এরপর নিয়মিত বোলিং করে আসছি, সঙ্গে ফিটনেসের কাজও। শনিবার ফিটনেস টেস্ট দেওয়ার পর নিজের সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা পেয়েছি। আজ আবার বোলিং করলাম, দেখা যাক কী হয়।'
বিরতিটা দীর্ঘ, এবার কারণ ভিন্ন হলেও বাকিদের মতো ক্রিকেট খেলা হয়নি মাশরাফিরও। গত মার্চে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মাচ খেলেন তিনি । এরপর মার্চে বিকেএসপিতে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে একটি ম্যাচ খেলেন মাশরাফি। মঙ্গলবার গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের বিপক্ষে খুলনার হয়ে খেললে প্রায় ৯ মাস পর কোনো ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হবে তার।
ক্রিকেটে ফেরার আগেও লড়াই করতে হয়েছে মাশরাফিকে। করোনাকালে কঠিন সময়ই গেছে তার। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে করোনায় আক্রান্ত হওয়া বাংলাদেশের সাবেক এই ওয়ানডে অধিনায়ক পরবর্তীতে আরও জটিলতর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, ছোট ভাই ও তার স্ত্রী; সবাই করোনায় আক্রান্ত হন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে মাশরাফিকে, এই লড়াইয়েও তিনি ছিলেন একা।
এখন পর্যন্ত একা লড়েও টিকে আছেন মাশরাফি। টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছা এখনও তার মধ্যে প্রবল। যে কারণে ৩৭ বছর বয়সেও বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অংশ অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। সামনের মাসে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ, নিশ্চয়ই এই সিরিজে চোখ আছে ডানহাতি এই পেসারের। এই সিরিজে সুযোগ পেতে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ হতে পারে মাশরাফির জন্য প্রস্তুতির মঞ্চ। এরপর জাতীয় দলের ক্যাম্পে সুযোগ পেয়ে নিজেকে আরও ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন তিনি।
২০০৯ সালের পর আর টেস্ট ক্রিকেট খেলা হয়নি মাশরাফির, টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ারও তিন বছর হয়ে গেছে। চলতি বছরের মার্চে ওয়ানডের অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর অনেকেই মাশরাফির শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়েও তারুণ্যের উদ্যোমে ছুটে চলেন যে মাশরাফি, সেই মাশরাফির দৃষ্টিসীমায় আপাতত 'ফুল স্টপ' নেই। আরও কিছুটা পথ লড়তে চান তিনি, একাই।