ফি বছর বইমেলা হয় কিন্তু লেখালেখি পেশা হয়ে ওঠে না!
স্বনামধন্য একজন লেখক ফেসবুকে তার পোস্টে লিখলেন, বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিম্ন আয়ের লোকদের কথা ভাবতে হবে। উত্তম প্রস্তাব। বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কম আয়ের লোকের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। এদের যদি কাজের সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি না থাকে, অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়, তাহলে তারা নিজেদের কাজগুলো মনপ্রাণ ঢেলে করবে কী করে?
এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রেই সত্যি। আয়-ব্যয়ে মিল না থাকলে, প্রয়োজনীয় খরচ সামলানোর জন্যে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান না হলে একজন মানুষ তার পেশাগত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে পারে না।
বইমেলা ও প্রকাশনা শিল্পে অবশ্য দুটি পক্ষই মুখ্য। দুই পক্ষের এক পক্ষে লেখক আরেক পক্ষে প্রকাশক। লেখক না হলে প্রকাশনা শিল্প দাঁড়ায় না, তেমনি প্রকাশক না হলে লেখকও অপ্রকাশ্য থেকে যান। প্রকাশক বই প্রকাশ না করলে লেখক শুধু শুধু লিখে কী করবেন? তার লেখা পাঠকের কাছে যাবে কী করে? এখানে প্রকাশক বিশাল ভূমিকা পালন করেন। বইয়ের মুদ্রণ থেকে বিপণন পর্যন্ত বিশাল খরচের ব্যাপারটা তাকেই সামলাতে হয়। অনেক লোক লাগে তাতে। অনেক টাকা খাটাতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও খাটতে হয়। তারপর বই বিক্রি করে যে টাকা আসে, তার পরিমাণ যদি বিনিয়োগের চেয়ে বেশি না হয়, তাহলে প্রকাশনা শিল্প হবে কী করে?
প্রকাশনা আসলে শিল্পসংস্কৃতি নয়, প্রকাশনা হলো মোটা কথায় শিল্প কারখানা। শিল্পসংস্কৃতি নিজ থেকে গড়ে ওঠে। কিন্তু শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হয়। তার জন্যে পুঁজি লাগে, শ্রম লাগে এবং কাঁচামালও লাগে। প্রকাশনা শিল্পের কাঁচামাল হলো লেখা। লেখার যোগানদাতা হলেন লেখক। সুতরাং লেখকও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু স্বনামধন্য লেখক তার পোস্টে লেখকের কথা বলেননি, বলেননি ওই শিল্পে একজন লেখকের অবস্থান ঠিক কোথায়?
একটা কথা অবশ্য অনেকেই বলে থাকেন। লেখকের প্রথম কাজ লেখা। লেখার সময় সত্যিকারের লেখক কখনো প্রকাশের কথা ভাবেন না। প্রকাশের চেয়ে লেখাটাই তার কাছে মুখ্য। অর্থাৎ যখন লেখা হয়, তখন সেটা লেখকের আত্মপ্রকাশ। লেখা হয়ে যাওয়ার পর পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারটা হলো তার প্রকাশ। আত্মপ্রকাশ স্বনির্ভর আর প্রকাশ হলো পরনির্ভর। প্রকাশের কাজটা প্রকাশকই করে থাকেন। সেটা অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। লেখকের কাছ থেকে লেখা নিয়ে তার প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে বিপণন পর্যন্ত সব কাজ তিনিই করে থাকেন। অর্থাৎ তিনি লেখকের কাছ থেকে লেখা নিয়ে তার পেছনে টাকা খাটান এবং লাভ করেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে কথা হলো, একটা লেখা একজন লেখকের কাছে সৃষ্টি আর প্রকাশকের কাছে পণ্য। এই পণ্যটা বাজারে তুলে প্রকাশক টাকা আয় করেন। কিন্তু লেখক তার সৃষ্টিতে আনন্দ পেলেও সৃষ্টি যখন পণ্য হয়ে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছায়, তখন তার জন্যে কী থাকে? সৃষ্টি যখন পণ্য হয়, তখন তার অর্থমূল্য কি লেখক পাবেন না?
হ্যাঁ পাবেন। যৌক্তিকভাবেই এটা বলা যায়, প্রকাশক লেখকের লেখা প্রকাশের পেছনে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অর্থ খাটিয়ে সেটাকে পণ্যে রূপান্তরিত করে ক্রেতার কাছে পৌঁছান। ক্রেতা টাকার বিনিময়ে সে পণ্য কিনে নেন। প্রকাশক তাতে লাভও করতে পারেন, লোকসানও দিতে পারেন। লেখক কিন্তু তার দায় ভোগ করেন না। লেখক প্রকাশকের কাছ থেকে একটা নির্ধারিত শতাংশে রয়ালটি পান। পণ্যে রূপান্তরিত গ্রন্থের স্বত্ব লেখকের থাকে। ওই বই যতবার মুদ্রিত হবে এবং বিক্রিত হবে, ততবারই লেখক তার রয়ালটি পাবেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখক তার স্বত্ব প্রকাশকের কাছে এককালীন টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলেন। এরপর বইটি যতবারই মুদ্রিত হোক, যত সংস্করণই বের হোক, লেখকের তাতে আর দাবি থাকে না। এটা সাধারণ ও স্বাভাবিক নিয়ম। মানে এরকমটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এ রকমটা কি হয়? আমাদের দেশে প্রকাশনা একটা শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও একজন লেখক কেবল লেখাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন না। কিন্তু প্রকাশক তার প্রকাশনাকে পেশা হিসেবেই নিয়ে থাকেন।
ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার লেখালেখির শুরু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। কবিতা ছড়া লিখে লিখে পত্রিকায় ছাপাচ্ছি। অনেক পত্রিকার মধ্যে কেবল একটা পত্রিকা থেকে লেখাপ্রতি ৫০ টাকা পাই। বাকিগুলোতে ছাপানোই সার। কিন্তু তাতেও অন্যরকম এক আনন্দ। আত্মপ্রকাশের সে সময়টা অনন্যসাধারণ। নিজের হাতের লেখায় পাঠানো একটা ছড়া, কবিতা বা গল্প ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে আসছে খবরের কাগজ কিংবা ম্যাগাজিনের পাতায়, এ আনন্দ-বিস্ময়ের অনুভূতির বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। কেবল একজন আত্মপ্রকাশোন্মুখ নবীন লেখকই এর স্বাদ উপলব্ধি করতে পারে মনপ্রাণ দিয়ে।
তো সে সময় কী একটা সাহিত্যাসরে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কবি-লেখক প্রয়াত বেলাল মোহাম্মদ ঢাকা থেকে গেলেন চট্টগ্রামে। মুসলিম হলের প্রাঙ্গনে আমরা উঠতি লেখকরা তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। বেলাল মোহাম্মদ এমনিতে কীর্তিমান মানুষ। তার সান্নিধ্য পাওয়াটা আমাদের জন্যে অনেক বড় একটা বিষয়। তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা আরেকটু বেশি। বেলাল মোহাম্মদ আমার উপজেলার লোক। তার ওপর আমার এক সহপাঠীর আপন মামা। আমি নিজে তার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে এক ফাঁকে কাছাকাছি চলে গেলাম। তাঁকে মামা ডেকে বললাম, আমি সেবকের ক্লাসমেট।
ভাগ্নের ক্লাসমেট শুনে বেলাল মোহাম্মদ একটু আগ্রহী হলেন। কথা টথাও বললেন। এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন আমি কী করি। আমি বললাম, কিছুই করি না। লেখালেখি করি।
মুহূর্তেই পাল্টে গেল সাদা পাঞ্জাবি-সাদা লুঙ্গিপরা সৌম্যদর্শন বেলাল মোহাম্মদের চেহারা। কিছুটা বকুনির সুরে বললেন, 'কিছুই করো না! লেখালেখি করো! আশ্চর্য! বাংলাদেশে এমন একজন লেখক দেখাও দেখি, যিনি কিছুই করেন না, কেবল লেখালেখি করেন?'
যে তীব্র আনন্দ আর আবেগের বশে বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়েছিলাম, তা নিমেষে উবে গিয়েছিল। যতক্ষণ তিনি ছিলেন, ততক্ষণ আর তার কাছাকাছি হইনি। চলে আসার আগে এক পর্যায়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর বললেন, 'মন খারাপ করো না। তোমাকে বকে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে বকার একটু অধিকার হয়তো আমার আছে। তুমি আমার এলাকার ছেলে। তার ওপর আমার ভাগ্নের বন্ধু। তাই তোমাকে না বকে পারিনি। তোমরা এখনো নবীন। জীবনকে বুঝতে পারছ না। আবেগে চলছ। কিন্তু আমরা অনেক পথ হেঁটে এসেছি। কিছুটা অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। তাই বলছি, এখনো সময় আছে। কিছু একটা করো। বাংলাদেশে কেউ লিখে চলতে পারে না। ইমদাদুল হক মিলন কিংবা হুমায়ূন আহমেদের কথা ভাবার দরকার নেই। তারা লিখে অনেক টাকা পান। কিন্তু এরপরও তাদের কিছু একটা করতে হয়।'
প্রকাশনা একটা শিল্প। এই শিল্পে টাকা খাটিয়ে, শ্রম বিনিয়োগ করে প্রকাশক থেকে শুরু করে প্রেসের চা-সিগ্রেট আনার পিচ্চিটা পর্যন্ত কম বেশি উপার্জন করে। প্রকাশককে তার প্রয়োজনীয় সব কিছুর মূল্য নগদ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু লেখক? না, তিনি তার লেখার দামটা পান না। অথচ গুরুত্বের দিক দিয়ে ধরতে গেলে তার পাওনাটাই সবার আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত।
এ পর্যায়ে বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশকের সে পুরনো দ্বন্দ্বটাই ফের উঠে আসতে পারে। লেখক বলেন, প্রকাশক টাকা দেন না। প্রকাশক বলেন, লেখকের বই বিক্রি না হলে টাকা কোত্থেকে দেব?
একটা প্রতিবেদনে পড়লাম, বাংলাবাজারের একজন নামী প্রকাশক, হুমায়ূন আহমেদের বই ছেপে যিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন, প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে ধাঁ করে বলে ফেলেছেন, 'বাংলাদেশে দশ জন লেখক পাই না যার ১২শ' কপি বই এক ধাক্কায় বিক্রি হয়ে যাবে।'
অর্থাৎ তিনি এক ধাক্কায় ১২শ' কপি বই বিক্রি হওয়া লেখক চান। তাহলে তার ব্যবসা চলবে, তাহলে তিনি লেখককে তার রয়ালটি দেবেন। আরো সোজা কথায়, তিনি তৈরি লেখক চান, লেখক তৈরি করতে চান না। কারণ তিনি একশভাগ বাণিজ্যিক। লেখক তৈরির হ্যাঁপা সামলাতে চান না।
তাহলে কী হবে? পুরনো দ্বন্দ্বটাই কি বছরের পর বছর যুগের পর যুগ চলবে?
বোঝাই যাচ্ছে, লেখক বড় একা। তিনি শুধু লিখতেই পারেন। কিন্তু সেটা পাঠকের কাছে পাঠানোর সুযোগ এবং সামর্থ্য কোনোটাই তার নেই। অতএব প্রকাশকই ভরসা। আর প্রকাশক তো নিজের টাকা খরচ করে স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন না। তাই লেখকের লেখা বিক্রি করে সবার আগে নিজের পুঁজি উদ্ধার এবং লাভ দুটোই করতে চাইবেন তিনি। অতিপ্রজ লেখকের দেশ বাংলাদেশে তাই লেখক তৈরির দায় তিনি নেবেন কেন? লেখকই বরং উঠে আসুক। এক ধাক্কায় ১২ শ' বই বিক্রি হওয়া লেখকের তালিকায় নাম লেখাক। সে লেখককে ১০০ টাকায় ৮-১০ টাকা দিতে ১০০ ভাগ বাণিজ্যিক প্রকাশকের তখন আর কষ্ট হবে না। কারণ তার তো ৯০ টাকা থাকছেই।
কিন্তু এক ধাক্কায় ১২০০ বই বিক্রি হওয়া লেখক হওয়ার আগে ওই লেখককে যে সঙ্কটসঙ্কুল সময়টা পার হয়ে আসতে হয়, সেই সময়টায় তাকে ছায়া দেয় কে?
- লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক