ভয়ঙ্কর অণুজীবের অনুশিক্ষণ!
গত একটা বছর ধরে অদৃশ্যপ্রায় এক অণুজীব গোটা পৃথিবীটাকে একরকম তছনছ করে দিল। সে কেবল একচেটিয়া নিয়েই গেছে আমাদের কাছ থেকে: প্রাণ, সম্পদ, স্বাস্থ্য, শান্তি, শৃঙ্খলা, শিক্ষা, সম্পর্ক, সান্নিধ্য, কী নয়! বিনিময়ে তার কাছ থেকে কি আমাদের কিছুই পাওয়ার কিংবা নেওয়ার থাকতে নেই?
করোনা নামক নিষ্করুণ এই অণুজীবটির কাছ থেকে আমরা ইতোমধ্যেই নিয়েছি, কিংবা ভবিষ্যতে নিতে পারি, তবে গোড়াতেই একটা কথা কবুল করে নিই যে, এই কথাগুলো আমার একান্ত নিজস্ব ও মৌলিক, সে রকমটি কিন্তু নয়।
এ-সম্পর্কে এর আগে অনেকেই অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বলেছেন, লিখেছেন; আমি সেগুলোকেই এই স্বল্প পরিসরে একত্রিত করে, আরেকটু গুছিয়ে, চুম্বকাকারে পরিবেশন করছি মাত্র।
এক.
করোনা নামক এই অণুজীবটি মানুষের তৈরি, নাকি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, সেই বিতর্কে না গিয়েও একটি কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে মানুষ যে-নির্বিচার নয়-ছয় আর ছেলেখেলা করেছে; তার ওপর যে-বিধ্বংসী অত্যাচার ও অনাচার হয়েছে, এটি তারই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ফল। অতএব আমরা যতি অদূর ভবিষ্যতে এরকম কিংবা এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো অতিমারির পুনরাবৃত্তি না চাই, তাহলে এই মুহূর্তে আমাদেরকে উন্নয়ন কিংবা অতিমুনাফার নামে জগতের প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং তাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙচুর আর কাটাছেঁড়া বন্ধ করে, তার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অভ্যাস গড়তে হবে। সেই সঙ্গে এ যাবৎকাল ধরে সংঘটিত পরিবেশের সমূহ ক্ষতিপূরণ, তার পুনর্সৃজন ও সুরক্ষার কাজে আমাদের সর্বস্ব নিয়োগ করতে হবে।
দুই.
এই অতিমারির কালে আমরা লক্ষ করেছি, করোনার মতো অণুজীবেরা কোনো সীমানা কিংবা সীমান্ত মানে না; তার কাছে নেই কোনো দেশকালপাত্রের বিন্দুমাত্র বাছবিচার। অন্যদিকে আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা কত না দেয়াল, কাঁটাতার আর সীমান্তপ্রহরা বসিয়ে নিজেদের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ করে তুলছি নিরন্তর। অথচ এই মুহূর্তে আমাদের দরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি করে সৌহার্দ্য, সংহতি, সহযোগিতা, সমমর্মিতা, দেওয়া-নেওয়া আর আসা-যাওয়ার সম্পর্ক স্থাপন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থাকে আরও বেশি শক্তিশালী, কার্যকর, প্রতিনিধিত্বশীল, অবাধ ও অধিগম্য করে তোলা।
তিন.
মাত্রাতিরিক্ত শিল্পায়ন, যান্ত্রিকীকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত নগরায়ণের যে-ধারা ও প্রবণতা বিশ্বজুড়েই দৃশ্যমান আজ, তার রাশটুকু টেনে ধরতে হবে অবিলম্বে। কেননা তা একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে বিপুলভাবে, প্রাণ-প্রকৃতির বৈচিত্র্য বিনাশ করছে, অন্যদিকে মানুষের সঙ্গে তার প্রতিবেশের যে-স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক তাকে বিঘ্নিত করছে; সর্বোপরি তার যূথবদ্ধ, সামাজিক জীবনকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও খর্ব করছে যে, তার পক্ষে এ-জাতীয় অভূতপূর্ব অতিমারি পরিস্থিতির মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চার.
এই অতিমারির কালে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, আন্তর্জালিক যোগাযোগপ্রযুক্তি, ঔষধ ও জৈবপ্রযুক্তি ইত্যাদির বহুল, বৈপ্লবিক ব্যবহার এবং বিস্ময়কর রকম ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ প্রয়োগ লক্ষ করেছি। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও দেখেছি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই সুফলটুকু ভোগ করেছে মূলত ধনী দেশগুলো; তুলনামূলকভাবে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহ এর আশীর্বাদ থেকে নিদারুণভাবে বঞ্চিত হয়েছে।
আমরা দেখেছি আমাজন অরণ্যের আদিবাসীরা কী অসহায়ভাবে এই অতিমারির শিকার হয়েছে, দেখেছি ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের অমানুষিক পীড়ন ও বঞ্চনার চিত্র, এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ ও অপরাপর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বেঘোরে প্রাণ হারানোর দৃশ্যও। এই উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার তাদের কোনো কাজেই আসেনি। প্রযুক্তি বা তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ সাফল্যের ক্ষেত্রে এহেন ন্যাক্কারজনক বৈষম্যের যে-কেতাবি নাম রয়েছে: ডিজিটাল ডিভাইড, করোনাকালে আমরা শুধু বিভিন্ন দেশের মধ্যেই নয়, একই দেশের ধনী ও দরিদ্র দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এর বিস্তার ও তীব্রতা লক্ষ করেছি।
এখন দরকার সেটাকে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে দ্রুততার সঙ্গে যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা। তা নইলে এই অণুজীবটির সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমরা যেরকম বিকট বৈষম্য দেখেছি, তার প্রতিকারের জন্য যে-প্রতিষেধকটি ধনী দুনিয়ার বাজারে আসি আসি করছে, সেটির সুষ্ঠু বিতরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও হয়তো একই রকম অব্যবস্থা, পক্ষপাতিত্ব ও দ্বিচারিতার দৃশ্য দেখতে হবে আমাদের।
এ-তো গেল বৈশ্বিক চিত্রটি, এবার দেখা যাক রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সামাজিক পরিসরে, বিশেষ করে আমাদের দেশে আমরা এই করোনার কাছ থেকে কী শিক্ষা নিয়েছি বা নিতে পারি।
এক.
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে করোনা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি কী রকম ভঙ্গুর, নাজুক এবং নিজেই কতখানি দুর্বল ও অসুস্থ সে- সরকারি, বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রেই। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রধান অসুখ-অদক্ষতা, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব, আর বেসরকারি ক্ষেত্রে পুঁজি ও মুনাফার নির্লজ্জ, নীতিবর্জিত আগ্রাসন এবং নজরদারিতার অনুপস্থিতি।
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একেবারে খোলনলচে পাল্টে নতুন করে ঢেলে না সাজালে, সামনের কোনো মহামারি পরিস্থিতিতে আমাদেরকে যে আরও চড়া মূল্য দিতে হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
দুই.
এই করোনা আমাদের সরকারি প্রশাসনের লেজেগোবরে অবস্থাটুকুও আর গোপন রাখতে দেয়নি এবার। আমরা দেখেছি অতিমারির একেবারে শুরু থেকেই বিদেশাগত যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন; করোনা পরীক্ষা করা; সংক্রমিতদের অনুসন্ধান ও বিচ্ছিন্নকরণ; লকডাউন ঘোষণা করে তাকে ছুটি বলে অভিহিত করা; ইদের ছুটিতে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থা; পোশাকশ্রমিকদের পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যেতে ও কাজে ফিরতে বাধ্য করা; লাল, হলুদ আর সবুজ অঞ্চল ঘোষণা করেও যথাযথ মানচিত্রের অভাবে তা বাস্তবায়ন করতে না পারা ইত্যাদি আরও অসংখ্য বিষয়ে আমাদের প্রশাসন কীরকম অযোগ্যতা, অক্ষমতা, অদক্ষতা ও সার্বিক দৌর্বল্যের পরিচয় দিয়েছে।
পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশে যে বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলের প্রবীণ ও মেধাবী মানুষদের মৃত্যু হয়েছে অনেক বেশি, যাদের মধ্যে রয়েছেন বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা, রাজনীতিবিদেরাও- এর দায়ভাগ কিন্তু অনেকটাই সামাজিক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ এই প্রশাসনের ওপর এসেই পড়বে।
এখানেও শিক্ষণীয় এটাই যে, স্রেফ মুখস্থবিদ্যার বিসিএস ক্যাডারদের দিয়ে আর যা-ই হোক একটি দেশের প্রশাসনিক মেরুদণ্ডটিকে বিশেষ সবল ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা সম্ভব নয়, তার জন্য চাই প্রশাসনের নতুন ও সৃজনশীল চিন্তা, পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন ও প্রয়োগ।
তিন.
করোনাকালে এই বাংলাদেশে আরেকটি যে-ক্ষেত্র প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে আমাদের শিক্ষাঙ্গন, এতটাই যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত খোলারই সাহস করা যায়নি, গণপরীক্ষাগুলো সব স্থগিত হয়ে আছে, অনলাইনে যেটুকু শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত আছে, সেটা সেই পূর্বকথিত ডিজিটাল ডিভাইডেরই কারণে নিতান্তই অপ্রতুল, অনির্ভরযোগ্য ও অকার্যকর, একথা নতুন করে না বললেও চলে। বাংলাদেশের শিক্ষার মান এমনিতেই ত্রিমুখী এক গুরুচণ্ডালী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ক্রমেই অধোমুখী, তদুপরি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো করোনার এই আঘাত তাকে কোথায় যে নামাবে, সেকথা ভাবতেও ভয় হয় বই কি।
তাহলে উপায়?
উপায় একটাই, বঙ্গবন্ধুর আমলে করা ড. কুদরত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন প্রস্তাবিত সেই বিজ্ঞান ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন, নিদেনপক্ষে ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর প্রয়োগ; পাশাপশি আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠক্রম নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ড চলছে সাম্প্রতিককালে তার অবসান এবং কোচিং নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে তাকে পুনরায় শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ।
সবশেষে আসা যাক ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী শিক্ষা দিয়ে গেল করোনা আমাদের, সেই বিষয়ে। সত্যি বলতে কী, এই অতিমারির অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন কিন্তু এসেছে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপন, জীবনচর্যা ও জীবনবীক্ষণের ক্ষেত্রে। সেটার বিস্তার পরিচ্ছন্নতাবোধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টিচেতনা, শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা, কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস, সূর্যালোকসেবনের গুরুত্ব থেকে শুরু করে স্বনির্ভরতার চর্চা, স্বল্পে সন্তুষ্টির শিক্ষা, পরিবারের প্রতি আনুগত্য, ত্রাণ ও মানবিকতাবোধের উন্মেষ, অপচয় পরিহার, প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে ওঠা, পাঠাভ্যাস ও সুকুমারকলার প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্র অবধি প্রসারিত।
আমরা যদি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছাতেই হোক করোনাকালে অর্জিত এইসব শিক্ষা, অভ্যাস ও প্রণোদনাসমূহকে আমাদের জীবনাচরণে স্থায়ীরূপ দিতে পারি, তাহলে তার যে-অবধারিত ইতিবাচক প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পড়বে, সেটার মূল্য কিন্তু নেহাত কম নয়। আর তার সঙ্গে যদি আমাদের সমাজনেতা, দেশনেতা ও রাষ্ট্রনেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয় এবং তাঁরা উক্ত নিবন্ধে পূর্বোল্লিখিত বৈশ্বিক, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক পরিসরের শিক্ষাসমূহকে বাস্তবিকই প্রয়োগে উদ্যোগী হন, তাহলে নিশ্চয়ই এই অতিমারির অবসানের পর আমরা আরেকটু সবুজ, সুন্দর, প্রাণবিক, শান্তিপূর্ণ, সম্প্রীতিময় ও স্বাস্থ্যকর এক পৃথিবীর দেখা পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারব।
প্রবল পরাক্রান্ত করোনার কবলে পড়ে আমাদের এই প্রিয় গ্রহটির যে-অবর্ণনীয় ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে এরই মধ্যে, তাহলে অন্তত তার কিছুটা হলেও পূরণের স্বপ্ন দেখতে পারব আমরা পুনরায়।
- লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, সংগঠক