কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই মমতার জন্য বুমেরাং!
পশ্চিমবাংলায় ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাজিমাত করে গেলেন গত শনিবার। অমিত সাহা এক জনসভায় ভারতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিএম তিন দল থেকে মোট ১০ জন বিধানসভা সদস্যকে নিজ দলে যোগদান করালেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের। সেই দলের সাত বিধানসভা সদস্য নিজ দল ত্যাগ করে অমিত শাহের বিজেপিতে যোগদান করেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের এই সাত সদস্যের মধ্যে একজন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে পূর্ণমন্ত্রী থাকাসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং দলীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কমিটির নেতৃত্বদানকারী এই শুভেন্দু অধিকারী। তার তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান এক নতুন বার্তা দিল পশ্চিমবাংলায় রাজনীতির অঙ্গনে।
একটানা পরপর দু'বার পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যখন তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক সেই মুহুর্তে দলের এই বিপর্যয়ে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তীব্র হলো। এর আগে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা মুকুল রায় মমতা দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করেন। দলত্যাগের কিছুকাল তিনি নিশ্চুপ ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি থাকার ফলে তাকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধানের মুখোমুখি হতে হয়। তারপরেই মুকুল রায় দল থেকে পদত্যাগ। আর পরবর্তীকালে বিজেপিতে যোগদান। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অভিযোগ উত্থাপন করেন যে, শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিমবাংলায় চাঁদাবাজি করেছেন। এটি ওপাড় বাংলায় তোলাবাজি হিসেবে পরিচিত। এপার বাংলায় যেমন আমাদের বাংলাদেশ যেমন এই অভিযোগে বেশকিছু সরকারি দলের নেতার নাম শোনা যায়, কারাগারের অন্তরালে পশ্চিমবাংলায় সেই ধরনের তোলাবাজির সঙ্গে যে সমস্ত নাম উঠে আসছে তার মধ্যে একজন অভিষেক ব্যানার্জি। আগে মুকুল রায়ের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ ছিল এবং তারপর শুভেন্দু অধিকারীর সমৃদ্ধ এই অভিযোগ ইঙ্গিত দেয় যে, পশ্চিমবাংলায় সারদা কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দুর্নীতির যে খাতা উম্মোচিত হয়েছে- তা এখনো পরিষ্কার হয়নি।
কেন্দ্রীয় সংস্থার সেই তদন্ত এখনো অব্যাহত। শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছেন যে মমতা ব্যানার্জি ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক ব্যানার্জিকে তার উত্তরাধিকার বানানোর চেষ্টা করছেন সেব্যাপারে পশ্চিমবাংলার নিরপেক্ষ মতের মানুষরাও তার সঙ্গে একমত। শুভেন্দু অধিকারী মমতা ব্যানার্জির অন্যতম সহযোগী ছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পশ্চিমবাংলার বাম শাসনের অবসান ঘটাতে এই শুভেন্দু অধিকারী মমতা ব্যানার্জির সংগঠনের সম্মুখ সারির নেতাই ছিলেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত মমতা ব্যানার্জি শুভেন্দু অধিকারীকে একাধিক মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন।
মমতা ব্যানার্জি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে তিস্তা পানি চুক্তি অন্যতম অন্তরায়। কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জি তিস্তা পানি চুক্তি হতে দেননি। ভারতে বেশ কিছুকাল দল ভাঙার রাজনীতি শুরু হয়েছে তার প্রভাব পশ্চিমবাংলায় দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে তৃণমূল-কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জির দলে নানান দল থেকে মানুষ যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে, বাম দলের নেতাকর্মীরা। এদের মধ্যে দুজন সিপিএমের এমএলএ থেকে দল ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগদান করেছিল, যারা আবার তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি একসময় যুব-কংগ্রেস নেত্রী ছিলেন এবং তার রাজনৈতিক পরিচয় সৃষ্টি হয়েছে কংগ্রেসের যুবনেত্রী হিসাবে। কংগ্রেস সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে অসম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে ব্যর্থ হয়েছে আজ তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জিরও সেই একই অবস্থা।
১৯৯২ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরে এই নেত্রী বুঝতে পেরেছিলেন কংগ্রেসের প্রতি সংখ্যালঘুদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। সংখ্যালঘুদের সমর্থন ফেরত পাওয়া যাবে না।
পশ্চিমবাংলায় উল্লেখযোগ্য অংশ সংখ্যালঘু মুসলিম থাকায় এই নেত্রী কংগ্রেস ত্যাগ করেন নতুন রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে তুলেন এবং তিনি যখন কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন, তার আগের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন।
বাবরি মসজিদ যখন ভাঙ্গা হয় তখন তার দল কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। এবং রাজীব হত্যাকাণ্ডের পরে তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসিমা রাও। তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন পশ্চিমবাংলার উল্লেখযোগ্য ভোট সৈনিক সংখ্যালঘু মুসলমানদের থেকে তাদের ভোট দরকার।
সেকারণেই মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল-কংগ্রেস গড়ে তোলেন। যদিও তার কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল-কংগ্রেস গঠনের সাথে পশ্চিমবাংলার হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তারাও তখন চাইছিল কংগ্রেসের পতন। রাজনৈতিক অঙ্গনে কংগ্রেস ছিল তখন তাদের প্রধান অন্তরায়। সেই কারণে এই যুবনেত্রী মমতা ব্যানার্জির নতুন দল গড়ার পেছনে আরএসএস, বজরং দল ইত্যাদির সমর্থন ছিল বলে কথিত আছে। তাদের একনিষ্ঠ সমর্থন এই রাজনৈতিক মসনদ আরোহনে সমর্থন জুগিয়েছিল মমতা ব্যানার্জিকে।
প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম সংখ্যালঘুদের সমর্থন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল- কংগ্রেসের উত্থান শুরু হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জোটকে পরাজিত করে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আহরণ করেন প্রথমবার ২০১১ সালে।
বিজেপি প্রথম থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণ নীতির অভিযোগ করেছ। আবার সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত রায়ের বিষয় কোন মত প্রকাশ করেন নাই মমতা বা তার দল তৃণমূল-কংগ্রেস। আবার সুপ্রিম কোর্টের তিন তালাক বিরোধী রায়ের এর বিপক্ষে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এর পক্ষ অবলম্বন করেছেন।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জি ভারতীয় শিল্প বিনিয়োগকারীদের যে সংকেত প্রদান দিয়েছেন, সেখান থেকে আজও পশ্চিমবাংলা বের হতে পারেনি। মমতার দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বারবার পশ্চিমবাংলায় বিনিয়োগ টানার চেষ্টা সত্যিকার অর্থে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়াও মমতা আদতে কেন্দ্রের সঙ্গে এক লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই সংঘাত হয়তো সামনের নির্বাচনে বুমেরাং হয়েই ঘুরে আসবে তার বিপক্ষে।