আইএমইডির পরিদর্শন: পিছিয়ে আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ
দুই ইউনিটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের মূল উপকরণ নিউক্লিয়ার রিএ্যাকটর প্রেসার ভেসেল ও স্টিম জেনারেটর রাশিয়া থেকে ১৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি নৌপথ পেরিয়ে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর হয়ে এখন প্রকল্পের গোডাউনে অবস্থান করছে।
অথচ নিউক্লিয়ার রিএ্যাকটর প্রেসার ভেসেল আসার পর তা চুল্লিতে স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। চুল্লি নির্মাণের কাজ শেষ না হওয়ায় নিউক্লিয়ার রিএ্যাকটর প্রেসার ভেসেল ও স্টীম জেনারেটর স্থাপন, পারমাণবিক জ্বালানী পূর্ণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ বলছে, কাজ শুরুর প্রথম সাড়ে চার বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৩২৪৫৮.৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। ১১৩০৯২.৯১ কোটি টাকার প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ করতে আগামী পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময়ে ব্যয় করতে হবে আরও ৮০,৬৩৪ কোটি টাকা।
২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যে নেয়া প্রকল্পটির অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করে আইএমইডি। বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে তৈরি করা প্রতিবেদনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আইএমইডির মহাপরিচালক মো: আব্দুল মজিদ সম্প্রতি পাবনার রূপপুরে প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শণ শেষে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় সাড়ে চার বছরে প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩২.৬৫ শতাংশ। তা ছাড়া কিছু কাজের বাস্তব অগ্রগতি সঠিকভাবে হিসাব করা হয়নি। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তাও খতিয়ে দেখার তাগিদ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজে তদারকির ঘাটতি রয়েছে। প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাগুলো নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এ সব সভা নিয়মিত আয়োজনের পাশাপাশি প্রকল্পের নজরধারি আরও বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্প অফিসের ডকুমেন্টেশনে দুর্বলতা রয়েছে। সব কাজের বাস্তব অগ্রগতির সঠিক হিসাব রাখা হচ্ছে না। নিয়মিত আপলোড হচ্ছে না প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য।
তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ লক্ষ্যের চাইতে খুব বেশি পিছিয়ে নেই বলে দাবি করেছেন প্রকল্পটির পরিচালক ডঃ মোঃ শৌকত আকবর।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে প্রকল্প অনুমোদন পেলেও এর কনক্রিট ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। আর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি হিসাব করা হয় কনক্রিট ঢালাই শুরুর দিন থেকে। এ হিসাবে প্রকল্পটির বয়স মাত্র তিন বছর, আর এ সময়ে কাজের অগ্রগতিও হয়েছে যথেষ্ট।
তিনি বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি অনেকটাই জটিল প্রকৃতির। শুরুর দিকে অর্থছাড় অনেকটাই কম থাকে। তা ছাড়া অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে বিদেশ থেকে যন্ত্র বা অন্যান্য উপকরণ আমদনির ঋণপত্র খোলার পর থেকেই আর্থিক অগ্রগতি হিসাব করা হয়। আর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে এলসি খোলার পর যন্ত্র আমদানি ও স্থাপনের পর তা কার্যকর প্রমানিত হলেই কেবল অর্থ ছাড় হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১১৩০৯২.৯১ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুইটি রিএকটর বিশিষ্ট দুই ইউনিটের সর্বমোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রকল্প সহায়তা হিসাবে রাশান ফেডারেশনের ঋণ বাবদ ৯১০৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অবশিষ্ট ২২০৫২.৯১ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড রিঅ্যাকশন নেটওয়ার্ক কাজে অগ্রগতি ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঠিকাদার কর্তৃক নির্মাণ সামগ্রী আমদানি ও প্রকল্প এলাকায় সরবরাহ কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। এ খাতে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৩.২৪ শতাংশ।
লং টার্ম ম্যানুফ্যাকচারিং ইকুইপমেন্ট সরবরাহে অগ্রগতি ৩২ দশমিক ৮৬ শতাংশ
করোনায় রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউন থাকা এবং বিদেশি বিশেষায়িত ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট পরিদর্শনে সীমাবদ্ধতার কারণে লং টার্ম ম্যানুফ্যাকচারিং ইকুইপমেন্ট নির্মাণের কাজে ধীরগতি রয়েছে। এর ফলে এ খাতে আর্থিক মাইলস্টোন অর্জণ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।
সরবরাহ করা হবে। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত শেষ হবার সাথে সাথে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।
করোনায় বিঘ্নিত প্রশিক্ষণ
প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরবর্তীতে স্থাপনা পরিচালনার লক্ষ্যে ১৪২৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও চার বছরে এ খাতে অগ্রগতি ১৩ শতাংশের কম। তিন ধাপে এ পর্যন্ত মাত্র ২৫৬ জন রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ পেয়েছে দেশে এসেছেন। রাশিয়ায় রয়েছেন ১০২ জন।
চলতি বছরে ৩৪৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও মার্চ মাস থেকে কেউ রাশিয়ায় যেতে পারেননি। এ পর্যন্ত ৫০ প্রশিক্ষনার্থীর ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তন হয়েছে।
হিসাব নেই প্রকৃত অগ্রগতির
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেক কাজের প্রকৃত বাস্তব অগ্রগতি হিসাব করা হয়নি বলে পরিদর্শণ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কী না তাও দেখতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিভূত আর্থিক অগ্রগতির হার সন্তোষজনক নয়। ১৯টি আবাসিক ভবন নির্মাণের মধ্যে তিনটির ফিনিশিং কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। আট ভবনের আসবাব সংগ্রহের কাজ এখনও চলছে, শুরু হয়নি দুই ভবনের আসবাব সংগ্রহ।
এতে আরও বলা হয়, নির্মাণ শেষে বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় গ্রীড অবকাঠামো স্থাপনের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও পিজিসিবি পিছিয়ে আছে।
সিডিউল অনুযায়ী ব্যাক ফিড পাওয়ার সরবরাহ, উপযুক্ত সঞ্চালন এবং গ্রীড অবকাঠামো নির্মাণ না হলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে।
ত্রুটি বিচ্যুতি বাড়ছে নজরধারীর অভাবে
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নজরধারীর অভাব রয়েছে বলে পরিদর্শণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতির সৃষ্টি হচ্ছে বলেও দাবি করেছে আইএমইডি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সরকারের পরিপত্র অনুযায়ী প্রতি তিন মাসে একটি হিসেবে এ পর্যন্ত ৩৮টি ও ডিপিপি অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি করে মোট ১১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৯ টি সভা।
পরিপত্রে তিন মাসে একটি করে মোট ৩৮টি ও ডিপিপিতে ছয় মাসে একটি করে ১৯ টি পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র নয়টি।
প্রতি মাসে একটি করে এ পর্যন্ত ১১৪ টি এডিপি রিভিউ সভার কথা থাকলেও হয়েছে ৪৫ টি। কোন সভাই নিয়মিত হয় না। এ সব বিষয়ে নজর দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, প্রকল্পের সাইটে রাখা পরিদর্শন বইয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্ত এ সব পরামর্শ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কোন প্রতিবেদন দেখা যায়নি।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের ক্রয় পদ্মতিতে কিছুটা ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। একই আইটেম একাধিক ক্রয়পদ্মতিতে কেনা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান, চুক্তি স্বাক্ষর ও চুক্তি সামাপ্তির ক্ষেত্রে একাধিক তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাক্বলনযোগ্য প্যাকেজগুলোও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সংশোধনের আভাস
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প সংশোধনের আভাস দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নতুন অভিজ্ঞতা। প্রকল্প শুরুর আগে চুক্তি, কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা করা যায়নি। ফলে নির্মাণ, সম্পদ সংগ্রহসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করতে হয়েছে। বিস্তারিত প্যাকেজে ভাগ না করে অনেক বিষয় থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। বাস্তবায়নের পর্যায়ে অনেক বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। প্রকল্পের পরবর্তী সংশোধনে এ সব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে।