মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে ওঠা ভারতীয় নারীদের জন্য সহজ হবে না
কোভিড-১৯ সঙ্কটে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন ভারতীয় এই প্রথম মন্দা পরিস্থিতির তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আর সঙ্গত অনুমানেই আর্থ-সামাজিক দৈন্যতায় সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন নারীরা। ঘরে-বাইরে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো তাদেরই কাঁধে। দুর্দশার ভারটাও তারাই বেশি বইবেন। আর এ পরিণতি দীর্ঘকাল ধরে থাকতে পারে।
একথা ঠিক, মুষ্টিমেয় কিছু শহুরে নারী লকডাউনের কালে ঘরে থেকে কাজ করার পদ্ধতিতে বেশ সুবিধাভোগী হন। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ তথ্যের ভিত্তিতে করা লিঙ্কডইনের এক গবেষণায় এমনটাই উঠে আসে।
সেখানে বলা হয়, ভারতজুড়ে স্থবিরতার কালেও এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে দেশটির কর্মস্থলে নারীদের অংশগ্রহণ ৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু, যা বলা হয়নি তা হলো; এসব নারীরা আসলে আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই সুবিধেপ্রাপ্ত শহুরে শ্রেণির এবং মূল নারী কর্মশক্তির যৎসামান্য অংশ মাত্র। অন্যদিকে, সিংহভাগ ভারতীয় নারীর জন্য সার্বিক অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক।
কোভিড-১৯ ভারতে নগরায়ন নির্ভর উন্নয়ন সংস্কৃতির বৈষম্যের সমস্যাটিকেও নতুন রূপে উন্মোচন করেছে। নগরীগুলোতেই বাস করেন বেশিরভাগ ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাদের মহল্লাগুলো সাজানো পরিপাটি, বসবাসের পরিবেশ গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় নানাবিধ সুবিধা সমৃদ্ধ। আর তাদের যারা সেবা দিয়ে জীবিকা অর্জন করেন, সেসব শহুরে দরিদ্রের বাস ঘিঞ্জি বস্তিতে।
সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের ধারাবি বস্তি। সেখানে কয়েকশ' পরিবারের জন্য পানির উৎস একটি। ব্যবহারের জন্য একটাই টয়লেট। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা সেখানে যে অসম্ভব সেকথা বলাই বাহুল্য।
শহুরে বিত্তবানেরা এই বঞ্চণাকে নাক সিটকে যুগের পর যুগ অবহেলা করেছেন। কিন্তু, মহামারী তাদের জীবনে গরীব-গুর্বোর দেওয়া সেবার অভাব হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে ছেড়েছে। এই প্রথম শহুরে সম্পন্নেরা বাস করতে বাধ্য হন ধাত্রী, ঠিকে আয়া, ঝাড়ুদার আর গাড়ি চালকদের ছাড়াই টানা কয়েক মাস। কিন্তু, তারপরও কী তাদের হৃদয় উন্মুক্ত হলো?
উত্তরটা সহজ, তা হয়নি মোটও। হলে অন্তন্ত সেইসব সেবা দেওয়াদের উন্নত জীবনমান চেয়ে তাদের জন্য একটা আন্দোলন সম্পন্নদের মধ্যে দেখা যেতো। তাদের এই প্রতিক্রিয়াহীন চিত্ত বৈষম্যের দশাকে প্রাণে আয়ত্ব করার মনোভাবটা স্পষ্ট করে।
যেমন; অনেক ধনী সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে চাকরি থেকে তাড়িয়েছেন বৃদ্ধ ড্রাইভার, ঝি, দারোয়ানসহ গৃহস্থালির অনেক কর্মীকে। আর অর্থের দৌলতে নিজে নিজে কাজ করতে কিনে আনেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, বেবি মনিটর আর ডিশওয়াশার ইত্যাদি ইত্যাদি।
সহানুভূতির কী চমৎকার উদাহরণ নীরবেই ঘটে গেল সবার অলক্ষ্যে। কই তা নিয়ে হইচই আর মাতামাতি? বলবেই বা কে? বুদ্ধিজীবী আর সংবাদ কর্মীরা কী শহুরে শ্রেণির অংশ নন?
ফিরে আসা যাক গৃহস্থালি কর্মীর দুর্দশায়। অকস্মাৎ পথে বসা এই কর্মীদের সিংহভাগই হচ্ছেন নারী। তারা এখন দৈনিক চাহিদা পূরণেই হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের সন্তানেরা স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। ওদের জন্যেও তো আসলে শিক্ষাব্যবস্থা নয়। সম্পন্নেরা এগিয়ে যাবে, দরিদ্ররা নিষ্পেষিত হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, এই কী নিয়তির লেখন নয়?
এদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে মুষ্টিমেয় কিছু চাকরির জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে লাখ লাখ বেকার। দরিদ্র নারীরা যার বড় অংশ। মহামারী পরবর্তীকালে দেখেশুনে ভালো চাকরি নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক সনদ তাদের নেই। অনেকেই বাধ্য হয়ে চলছেন নিকটাত্মীয়দের করুণা নিয়ে। কালকেই যদি পুরো ভারতীয় সমাজ স্বাভাবিক লয়েও ফেরে, তবু এই নারীরা সহসা এই দশা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। কঠোর পরিশ্রমের স্বাভাবিক জীবিকার সুযোগও তাদের থেকে যেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
সবটাই নিষ্ঠুরতা এমনও নয়। গৃহকর্মীদের অনেক চাকরিদাতা গৃহস্থ এখন নিজেরাই মন্দার স্রোতে দিশেহারা। জীবনযাত্রার মান রক্ষায় খেই হারিয়েছেন অনেকে। অনেকের পতন হয়েছে প্রকৃত মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্তরে।
এই দশা ভারতের দরিদ্র নারীদের জন্য আশার সঞ্চার করে না। কারণ, গৃহস্থালির কাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য আছে ভারতেই। অর্থাৎ, নারীরাই ঘরের সকল কাজে জড়িত। তাই চাকরিদাতার ঘরে আয়ের প্রবাহ বাড়লে তার সবচেয়ে বড় সুবিধা পান গৃহকর্মী নারীরা। তাদের চাকরির বাজার বাড়ে, এবেলা- ওবেলা দু-চার বাড়ি একসঙ্গে কাজ করে বাড়ি নিয়ে আসতে পারেন বাড়তি দুটি টাকা। স্বামীদের স্বল্প আয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি, সন্তানের পড়াশোনা, বিপদে-আপদে দরকার, ওষুধের পথ্য কতকিছুই তো চাহিদা মেটে কোনমতে।
এতদিন তাই মিটে আসছিল, কিন্তু অর্থনীতির শাটডাউন আর বিদ্যালয় বন্ধ থাকায়- সেই ব্যবস্থাও বিঘ্নিত হলো। আরও নতুন চাপ বাড়লো দরিদ্র নারীর ঘাড়ে।
অর্থনীতিবিদ অশ্বিনী দেশপাণ্ডে তার এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখতে পান, অভাবের তাড়নায় এখন নারী প্রধান গৃহস্থালি কাজের বাজারে ভাগ বসিয়েছে পুরুষেরা।
বসন্তের লকডাউনের কালেই এ হাল ছিল। অবশ্য আগস্ট নাগাদ একাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ কিছুটা কমলেও, তা ছিল মহামারী পূর্ব সময়ের চাইতে অনেক বেশি।
গবেষণাটি আরও বলছে, শিক্ষিত পুরুষেরা ঘরের কাজে তাদের সঙ্গিনীর চাইতে কম সময় ব্যয় করেছেন। ফলে ধাই বা আয়া ছাড়া ঘর সামলানো আর বাচ্চাদের দেখাশোনা দুই ধরনের কাজ করতে গিয়ে বাড়তি কষ্টের শিকার হচ্ছেন গৃহিণীরাও। নতুন কেনা ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট তেমন সাহায্যও করতে পারছে না।
ভারত মহামারী পূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেসে ফিরলে হয়তো নারীদের কষ্ট অনেকখানি লাঘব হবে। অনেক পরিবার তখন গৃহকর্মী নিতে পারবে। কিন্তু, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দিনমজদুর ঘরের বাইরেও কাজ করে। তাদের দশা আরও নাজুক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানবেতরই বলা চলে। দীর্ঘসময় হয়তো তাদের অবস্থার উন্নতি আশা করা যাবে না।
এমন ভয়ঙ্কর কথাই বলছে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির গবেষণা। সংস্থাটির মতে, অর্থনৈতিক অভিঘাত আর মহামারীর তাণ্ডবে বৃহত্তর শ্রমবাজারে নারীর তুলনামূলক কম অংশগ্রহণ আরও সীমিত হয়ে পড়েছে। সাবালক পুরুষের ৭১ শতাংশের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ হার এখন ১১ শতাংশ।দিনমজদুরির বাজারে এই সীমিত উপস্থিতির পরও ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছে বেশি নারীরাই। নারীদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হারানোর এই হার ১৭ শতাংশ আর পুরুষের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ। নির্মম পরিহাস এখানেই।
লকডাউনের পর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কিছুটা উত্তরণ দেখা যায়। কিন্তু, সেখানেও দেখা যায় নারীর প্রতি বঞ্চণা। নভেম্বর নাগাদ অধিকাংশ পুরুষ বসন্তের লকডাউনে হারানো চাকরি ফিরে পান। আর মাত্র অর্ধেক নারী পেয়েছেন সেই সুযোগ।
সবচেয়ে আতঙ্কের কথা জানা গেছে সিএমআইই'র এক প্রতিবেদন সূত্রে। সেখানে ২০এর প্রথমভাগে থাকা তরুণীদের ওপর মহামারীর প্রভাব তুলে ধরা হয়।সংস্থাটি জানাচ্ছে, ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বদল আর ২০১৭ সালের পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রবর্তনের ধাক্কা দুটি গত বছরের শেষ নাগাদ কেবল কাটিয়ে ওঠা শুরু করেছিলেন এসব তরুণী কর্মীরা। কর্মস্থলে তাদের অংশগ্রহণ উন্নীত হয় ১৪.৭ শতাংশে, কিন্তু এখন মহামারীর তাণ্ডবে সেই হার নেমে গেছে ৮.৭ শতাংশে।
বোঝাই যাচ্ছে, আর্থ- সামাজিক লড়াইয়ে নারীর পতন তাকে আরও দীর্ঘ সংগ্রাম আর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট করে। ভারতের জন্যে তা সবচেয়ে বেশি সত্য। কারণ, এখানে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই নারীরা শৃঙ্খলিত, অবেহেলিত। পরিবারের উচ্চাশার চাপে তারা নিজেদের ভালোমন্দ ঠিক করতেও পদেপদে বাধার শিকার হন। তাই ভারতীয় অর্থনীতি আজ ঘুরে দাঁড়ালেও কিশোরী,তরুণী, যুবতী, বা বয়োবৃদ্ধা কর্মমুখী কোনো নারীর গঞ্জণা তাতে সহসাই ঘুচবে না।
- লেখিকা: জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কাটাস সেন্টারে যুক্ত জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো।
- মূল থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ