দিনাজপুরে ৫ বছরে চালের দাম দ্বিগুণ
শস্যভাণ্ডার খ্যাত দিনাজপুরে প্রতি বছরই বাড়ছে চালের দাম। গত ৫ বছরে এই জেলায় প্রকারভেদে চালের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে মুদ্রাস্ফীতির ভূমিকা থাকলেও বেশি দায়ী মাত্রাতিরিক্ত মজুদ। অর্থনীতিবিদদের দাবি, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে। যদিও চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াকে কৃষকদের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
দিনাজপুরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে মোটা চাল বা গুটি স্বর্ণ চাল ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকা দরে, সুমন স্বর্ণ ২৩৫০ টাকা বস্তা দরে, বিআর আটাশ জাতের চাল ২৬০০ টাকা বস্তা দরে, বিআর উনত্রিশ জাতের চাল ২৫০০ টাকা বস্তা দরে আর মিনিকেট জাতের চাল ২৮০০ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুতেও এসব চালের মূল্য ছিল বস্তাপ্রতি গুটি স্বর্ণ চাল ১৫৫০ টাকা, সুমন স্বর্ণ ১৭০০ টাকা, বিআর আটাশ ১৮০০ টাকা, বিআর উনত্রিশ ১৭০০ টাকা ও মিনিকেট ২১০০ টাকা বস্তা। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের শুরুতে এসব জাতের চালের মূল্য ছিল গুটি স্বর্ণ বস্তা প্রতি ১৩০০ টাকা, সুমন স্বর্ণ ১৪০০ টাকা, বিআর আটাশ ১৭৫০ টাকা, বিআর উনত্রিশ ১৬৫০ টাকা ও মিনিকেট জাতের চাল ২৩২০ টাকা।
২০১৫ সালের শেষ দিকে প্রতি বস্তা গুটি স্বর্ণ চাল ছিল ১১০০ টাকা, সুমন স্বর্ণ ১৩০০ টাকা, বিআর আটাশ ১৭০০ টাকা, উনত্রিশ ১৬০০ টাকা এবং মিনিকেট জাতের চাল ছিল বস্তাপ্রতি ১৯৫০ টাকা।
এই হিসেবে ২০১৫ সালের শেষের দিকে চালের যে দাম ছিল, ২০২০ সালের শেষের দিকে অর্থাৎ গত ৫ বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে বস্তায় ৮৫০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকা। দামের ব্যবধানে শতাংশের দিক দিয়ে যা প্রায় ১৪৩ দশমিক ৫৯ থেকে ১৮০ দশমিক ৭৭ বেশি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৫ সালের শেষের দিকে বাজারে গুটি স্বর্ণ জাতের চালের কেজি ছিল ২২ টাকা, যা ৫ বছর পরে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা দরে। এমনিভাবে ৫ বছরের ব্যবধানে সুমন স্বর্ণ ২৬ টাকার স্থলে ৪৭ টাকা, বিআর আটাশ ৩৪ টাকার স্থলে ৫২ টাকা, বিআর উনত্রিশ ৩২ টাকার স্থলে ৫০ টাকা আর মিনিকেট চাল ৩৯ টাকার স্থলে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি বছরই এই চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কৃষক নেতা ও মিল মালিকরা। তারা বলছেন, ধানের মূল্য না পেয়ে এক সময়ে কৃষকদের যে ধান চাষে আগ্রহ কমে গিয়েছিল, তা আবার ফিরে এসেছে ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায়।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বদিউজ্জামান বাদল বলেন, 'গত ২ বছর আগেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাননি। যার ফলে তারা ধান আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন ধানের মূল্য পেয়ে তা আবারও ফিরে এসেছেন। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।'
'কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করা হয় এবং প্রতিটি ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র যাতে চালু করা হয় দীর্ঘদিন ধরে সেই দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। এর মধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের দাবিটি পূরণ হয়েছে। এখন পূরণের অপেক্ষায় আছি প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারিভাবে ক্রয় কেন্দ্র চালু করার। এটি হলে কৃষকদের যাতায়াত খরচ ও হয়রানি কমবে এবং কৃষকরা আরও লাভবান হবেন,' বলেন তিনি।
চাল ব্যবসায়ী ও আড়ৎদার দিনাজপুর বাহাদুর বাজার এলাকার মেসার্স খাদ্যভাণ্ডারের সত্বাধিকারী আলাল বেপারী বলেন, 'বড় বড় মিল মালিকরা ইচ্ছেমতো ধান-চালের মজুদ গড়ে তুলছেন এবং দাম বৃদ্ধি করছেন। যেভাবে দাম বাড়ছে, এভাবে বাড়ার কথা না। এজন্য সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা যারা ব্যবসার সঙ্গে রয়েছি, আমরাও চাই বাজারটি নিয়ন্ত্রণে থাকুক। কৃষকরা যেমন লাভবানই হোন না কেন, লাভবান হচ্ছেন মধ্যসত্বভোগী কিছু ব্যবসায়ী।'
বাংলাদেশ মেজর ও অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, 'সবাই বলছে, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। আমরা বারবার বলে আসছি, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। ধানের দাম বাড়ছে, যার কারণেই চালের দাম বাড়ছে। আর ধানের দাম বাড়ছে মানেই কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন- এ অভিযোগ সত্যি নয়। কারণ বাজারে এখন ধানের যে মূল্য, সে অনুযায়ীই চালের মূল্য বাড়ছে।'
দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: আশ্রাফুজ্জামান বলেন, 'দেশে মোট ৭৫ শতাংশ কৃষক। আর এই কৃষকদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ধান চাষ করেন। মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী চালের মূল্য বেড়েছে, এটি কিছুটা ঠিক। তবে চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ, ধানের মূল্য বেড়েছে। গত ২ বছর আগেও যে মোটা ধান ৫৫০-৬০০ টাকা মন দরে বিক্রি হয়েছে, বর্তমানে সেই ধান ১১০০ টাকা মন। তার মানে, প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ধানের মূল্য। আর এই মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকদেরও ধান চাষে আগ্রহ বেড়েছে।'
অন্যদিকে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক হাবিবুল ইসলাম বলেন, 'চালের দাম বাড়ছে অযৌক্তিক কারণে। এর মধ্যে রয়েছে মিল মালিকদের মজুদ। যে পরিমাণে ধান উৎপাদন হচ্ছে, তার ব্যাপক পরিমাণ ধান মিল মালিকরাই ক্রয় করছেন এবং মজুদ গড়ে তুলছেন। আসলে, কৃষকরা ধান কাটা-মাড়াইয়ের পর দ্রুত বিক্রি করে দেন। আর মিল মালিকরা তা ক্রয় করে মজুদ করেন এবং পরে দাম বৃদ্ধি করেন।'
'সরকার ধান কম পরিমাণে ক্রয় করছে, আর অধিক পরিমাণে চাল ক্রয় করছে। কিন্তু সরকারকে আরও অনেক বেশি ধান ক্রয় করতে হবে। প্রয়োজনবোধে কৃষকের উৎপাদিত সব ধান সরকারকে ক্রয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। যদি কৃষকদের উৎপাদিত সব ধান সরকার ক্রয় করত, তাহলে কৃষকরাও লাভবান হতেন এবং সরকার চালের মূল্যও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো,' যোগ করেন তিনি।
আরও বলেন, 'এজন্য সরকারকে বেশি করে ধান ক্রয় করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে ধান থেকে চাল তৈরি করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে চালের দাম বেড়েছে, এটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কারণ এত বেশি মুদ্রাস্ফীতি হয়নি। মূলত ব্যবসায়ী শ্রেণিরাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।'
'গত ২০১৬ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ, ২০১৭ সালে ছিল ৫ দশমিক ৭০, ২০১৮ সালে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ আর ২০২০ সালে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ,' বলেন অধ্যাপক হাবিবুল ইসলাম।