“বিশ্বে গণতন্ত্র প্রচারের অধিকার নেই আমেরিকার, নিজ দেশেই সে ব্যর্থ”
কিছু প্রচলিত কৌতুক হঠাৎ করে রূপ নিতে পারে রুঢ় বাস্তবে। তখন সেটা আর সুখকর ঠেকে না।
এই যেমন একটি বহুল প্রচলিত কৌতুক ছিল; "কেমন হবে যদি সাংবাদিকেরা মার্কিন রাজনীতি নিয়েও সেভাবেই লেখা শুরু করেন যেভাবে তারা তৃতীয় বিশ্বকে নিয়ে লেখেন?" ২০১৬ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণের পর এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসেছে অনেক সংবাদ বিশ্লেষণে।
২০২০ সালের নভেম্বরে সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর কৌতুক পায় নতুন মাত্রা। টুইটার ব্যবহারকারীরা অসংখ্য মজাদার পোস্ট করেছেন ট্রাম্পকে নিয়ে। তার মধ্যে একটি ছিল; সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশের এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রপতি হেরে গিয়েও জেদ ধরে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে চলেছেন।
সব কৌতুক আর হাস্যরসের সমাপ্তি আছে। কখনো-সখনো তা ভয়ঙ্কর রূপও নেয়। তেমনটাই দেখা গেল গত বুধবার বিকেলে (স্থানীয় সময়) মার্কিন রাজধানীতে। ওই সময় ট্রাম্প সমর্থক সহিংস জনতা মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের বাঁধা পেরিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে আগ্রাসন চালায়। তাদের উচ্ছৃঙ্খল উপস্থিতির কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে সরিয়ে নেওয়া হয় আইনপ্রণেতাদের। এই নাটকের যবনিকাপাত শেষমেষ টিয়ারশেল নিক্ষেপ, গুলিবর্ষণে; এপর্যন্ত তাতে ঝরে গেছে ৪টি তরতাজা প্রাণ।
এই চিত্র কী অতীতের কোনো ঘটনা মনে করায়? মনে পড়ে কী সোভিয়েত শাসন পতনের পর বরিস ইয়েলেৎসিনের ট্যাংকের উপরে উঠে দাঁড়ানো, ভেনেজুয়েলার উত্তাল রাজপথ বা আরব বসন্তের কথা। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ভালো করেই জানেন, এতদিন যুক্তরাষ্ট্র-ই বারবার বলে এসেছে যে, "দুর্বল গণতন্ত্র স্বৈরশাসনে রূপ নেয়। এমন ব্যবস্থা কোনো দেশকে নৈরাজ্য আর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে তলিয়ে দেয়। ক্ষমতার পালাবদলও দেশকে এক দুঃশাসক থেকে আরেক নির্যাতক নেতার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।"
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আলোচনা যে কতোটা পথভ্রষ্ট ও অন্ধ- এই দৃষ্টিভঙ্গি তারই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মার্কিন নীতি বিশারদ, নাগরিক সমাজ আর রাজনীতিকদের অন্যদেশ নিয়ে অবজ্ঞা আর বিশ্ব নেতৃত্বের দাবির মিথ্যে অহংকারে গড়া বালির প্রাসাদ।
সাম্প্রতিক হালচিত্র অনুসারে এখন গণমাধ্যমে গরম আলোচনা প্রসঙ্গ; যুক্তরাষ্ট্রের এ নাজেহাল দশা দেখে না জানি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মনে মনে কতোই না খুশি হচ্ছেন। আর এখান থেকে আমেরিকার উত্তরণ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকবে কিনা- তা নির্ণয় করবে।
ওবামা প্রশাসনের আমলে রুশ রাজধানী মস্কোতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউল এক টুইটে লিখেছেন, "ট্রাম্প পুতিনকে তার নতুনতম এবং সবশেষ উপহারটি দিলেন।" একথার মাধ্যমে তিনিও উদ্ভূত সঙ্কটে বিদেশি শত্রুর আনন্দের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন।
অন্যদিকে, ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি'র মতো মার্কিন এনজিওদের গ্রুপগুলো একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, "যুক্তরাষ্ট্রে যাই ঘটুক, বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় তারা সমমনাদের সমর্থন দান অব্যাহত রাখবে।" সোজা কথায়; নির্বাচনী ফলকে সনদ দেওয়া বন্ধের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, সহিংস জনতার ক্যাপিটল হিলে চড়াও হওয়ার মধ্যে এসব মার্কিন বিদেশ নীতিতে প্রভাব ফেলা শক্তিগুলো উদ্বিগ্ন। তাদের শঙ্কা, আর বুঝি যুক্তরাষ্ট্র অন্যদেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার নিয়ে হম্বিতম্বি করতে পারবে না। এবার বুঝি চীনা প্রভাবের কাছে হার মানতে হবে আমেরিকাকে।
এধরনের প্রতিক্রিয়াকে বাস্তবতা বর্জিত বললে কমই বলা হয়। আমি বুঝিনা এরা কীভাবে এতোটা অন্ধ। তাও আবার চারপাশ দেখেশুনে। হায়! আজ যুক্তরাষ্ট্র বহিঃবিশ্বে গণতন্ত্র রক্ষা দূরে থাক, নিজেই তার চেয়ে বড় সঙ্কটের আবর্তে। চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা, প্রতিযোগিতার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য- সেতো অনেক পরের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতি আজ কয়েক দশকের অন্তর্কোন্দল আর দলীয় বিভাজনে কলুষিত। যদিওবা, বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সেই তুলনায় অনেক বেশি সহনশীলতার সক্ষমতাও দেখিয়েছে, কিন্তু কতদিন তারা এভাবে কার্যকর থাকতে পারবে- সে প্রশ্ন এখনই তোলার সময়। তারা কী আগামীদিনের আরও জনপ্রিয় আরও ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসক হতে চাওয়া কোনো রাষ্ট্রপতিকে বাঁধা দিতে পারবে?
মার্কিন জনতা দলমত নির্বিষেশে যে প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখেন, সেটা হচ্ছে সামরিক বাহিনী। কিন্তু, এই আস্থার নিজস্ব ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিও আছে। ঝুঁকি বলতে বোঝাতে চাইছি, গণতন্ত্রের পরবর্তী মারাত্মক সঙ্কটের কালে সেনা শাসনের সম্ভাবনা।
যাই হোক, আগামী দূরে থাক, নিকটবর্তী সময়ই আজ আর নিশ্চিত নয়। নিঃসন্দেহে বুধবারের সহিংসতা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে ক্ষুণ্ণ করবে, কিন্তু গত চার বছরে ট্রাম্প তো কম ক্ষতি করেননি। নভেম্বরে নির্বাচনের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যে রাজনৈতিক সহিংসতা চলেছে; তার ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে জোট করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
মার্কিন নীতি-নির্ধারকেরা যেভাবে চীনকে ঠেকাতে "গণতান্ত্রিক জোট" গড়ার অনির্দিষ্ট ও অসম্পূর্ণ বুলি আওড়ান, তার অসারতা এবার প্রমাণের পালা। নিজ গণতন্ত্রের মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় ডুবে থাকারা এতদিন নিজ দেশের বেহাল দশা নিয়ে উদাসীন ছিলেন। সেই উদাসীনতা মাসুল কী আগামীর ইতিহাস সুদে-আসলে আদায় করবে না?
সোজা কথায় বলতে চাই; আমেরিকা ঘর সামলাতে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলুক- সে আহ্বান আমি লিখতে বসিনি। বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রেখে যুক্তরাষ্ট্র সবদিক থেকেই লাভবান। কিন্তু, বুধবারের চিত্র আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক ফাটল উন্মোচন করেছে। সেটি হচ্ছে; ঘরোয়া রাজনীতির বাস্তবতা এবং অর্থনীতির শনির দশাকে আমলে না নিয়ে- পররাষ্ট্রনীতি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা।
মার্কিনীরা যদি নিজ গণতন্ত্রের শাসনে আস্থা রাখতে না পারে, যদি নতুন সরকারের প্রতি দেশের অর্ধেক মানুষ বিরূপ হয়; তাহলে কীভাবে অন্ধের মতো এটা বিশ্বাস করা সম্ভব যে, জো বাইডেন শপথ নেওয়ার পরই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? যার ঘরে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা নেই, সেই যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে অন্যদের জন্য সফল গণতন্ত্রের আদর্শ উদাহরণ হবে?
ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক অভিজাত রাজনীতিক ও পণ্ডিত মহল আজো গত তিন দশক ধরে চলে আসা একক পরাশক্তির মার্কিন ইমেজ রক্ষা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এই মুহূর্তে তা যেন প্রাণঘাতী কৌতুক। বাস্তবতার প্রতি ব্যঙ্গ। অথচ সদ্য বিদায় নেওয়া ২০২০ সালেই বিশ্ব আমেরিকার ভাবমূর্তি সম্পর্কে কী বার্তা পেয়েছে- সেটা তারা বেমালুম ভুলেই গেছেন।
- সূত্র: ফরেন পলিসি
- লেখক: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নির্দলীয় গবেষণায় জড়িত থিঙ্কট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের- স্কোক্রফট সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিক্যিউরিটির নিউ আমেরিকান এনগেজমেন্ট ইনিশিয়েটিভ- এর একজন সিনিয়র গবেষণা ফেলো।