লাল তীর: বদলে দিয়েছে কৃষি
দুই দশক আগেও লাল তীর ছিল মাল্টিমোড গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজ লালতীর কৃষি বীজ বাজারের এক বৃহৎ ব্র্যান্ডের নাম। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবনের তালিকায় এখন অন্তত ২০০ প্রজাতির সবজি ও ধান বীজ রয়েছে।
কয়েক দশক আগেও কৃষকদের জন্য সবজি, ধান ও অন্যান্য ফসলের বীজের ব্যবস্থা করা ছিল এক কঠিন বিষয়।
দেশব্যাপী ডিলারদের মাধ্যমে বীজ বিতরণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন।
কৃষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎপাদিত ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করে থাকত। ফলনের হার ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। বীজের মান সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।
১৯৯০ সালের পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে প্রবেশ করলে বীজের বাজার সম্প্রসারিত হয়। কৃষকদের জন্য বিভিন্ন জাতের বীজ সংগ্রহ করাও হয়ে উঠে সহজলভ্য।
বাংলাদেশের ফসলি বীজের খাত বদলে দিতে যেসব প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে লাল তীর সীড লিমিটেড অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী আবহাওয়া এবং মাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নত জাতের বীজ বাজারে আনতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে আসছে।
১৯৯৫ সালে বেসরকারী খাতের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে বীজ উৎপাদন শুরু করে এখন পর্যন্ত গবেষণার মাধ্যমে ১৯০টি নতুন জাত উদ্ভাবন ও বাজারজাত করেছে লাল তীর।
ব্যবসায়িক প্রসারণের সাথে প্রতিষ্ঠানটি বীজ উন্নয়নের গবেষণার ক্ষেত্রেও মনোযোগী হয়ে ওঠে। সবজি ও ফসলের বীজ থেকে শুরু করে পশুসম্পদ নিয়েও গবেষণায় নামে প্রতিষ্ঠানটি।
এখন পর্যন্ত লাল তীর সিড লিমিটেড সবজি ও ধানের ২০টি নতুন জাতের উদ্ভাবন করেছে যা পরিবেশের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে।
বীজ উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠানটি উপকূলীয় অঞ্চলে গবেষণার মাধ্যমে আরও উন্নতজাতের বীজ উদ্ভাবনের জন্য নিয়মিত কাজ করছে বলে জানা গেছে। ২০০৭ সাল থেকে তারা বীজের ভ্যারাইটির উপর গবেষণা শুরু করে।
উপকূলীয় অঞ্চলের উপযোগী ফসলের কার্যকারীতা বৃদ্ধির জন্য বাগেরহাটের সন্ন্যাসী বাজারে স্যালাইন ব্রিডিং এন্ড টেষ্টিং সেন্টার তৈরি করেছে লাল তীর। এই সেন্টারের মাধ্যমে লবণাক্ততায় টিকতে পারবে এমন প্রজাতি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা চলছে। এখানে নতুন জাতের উদ্ভাবনের কাজও চলছে নিয়মিত।
প্রতিষ্ঠানটি ডাচ সরকারের অর্থায়নে 'জিওবিস' এবং 'স্যালাইন টলারেন্ট ভেজিটেবল কালটিভেশন' শিরোনামের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও করছে।
লাল তীর জিওবিস প্ল্যাটফর্ম স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে কৃষকদের এসএমএস প্রেরণ করে আবহাওয়া সম্পর্কিত পূর্বাভাস জানিয়ে থাকে। এছাড়া প্রজেক্টটির আওতায় একটি অ্যাপও নির্মাণ করা হয়েছে। রেজিস্টারকৃত কৃষকদের আবহাওয়া বিপর্যয় এবং পোকামাকড়দের হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানে খোলা হয়েছে একটি কল সেন্টার।
দ্বিতীয় প্রকল্পটি এখনো চলমান। জানা গেছে, উপকূলীয় ১৯ টি জেলার যেসব জায়গায় প্রতিনিয়ত লবণাক্ত মাটি ও পানির পরিমাণ বাড়ছে, সেখানকার উপযোগী জাত উদ্ভাবন, পানির সঠিক ব্যবহার, কৃষি ব্যবস্থাপনা ও নতুন ভ্যরাইটি বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
লবণাক্ত মাটি ও পানিতে চাষের উপযোগী ৮টি নতুন প্রজাতি নিয়েও গবেষণা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে অবস্থিত নেদারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার ওসমান হারুনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নেদারল্যান্ড বরাবরই বাংলাদেশে জ্ঞান এবং প্রযুক্তির স্থানান্তর নিয়ে কাজ করে আসছে। লাল তীর এখন মূলত ভ্যারাইটিগুলো উন্নত করার পাশাপাশি তাদের বাণিজ্যিক উৎপাদনও করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিস্থিতিতে 'জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি উৎপাদন' নিয়ে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।'
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে, ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু সবজির গ্রহণ বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। অথচ তখন চাহিদা ছিল ২২৫ গ্রাম। এখন অবশ্য ভোগের পরিমাণ ১৫০ গ্রামের কাছে উঠেছে। এর মূল কারণ উৎপাদন বৃদ্ধি। গত অর্থবছরে সারাদেশে উৎপাদন দুই কোটি টনের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে।
বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, হাইব্রিড বীজের প্রসার এবং সারা বছর সবজি উৎপাদনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সার্বিক ভূমিকা রাখেছে।
ছয়টি হাইব্রিড প্রজাতিসহ একশটি উচ্চ ফলনশীল ধান নিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (বি আরআরআই) দেশে ধান বীজ উৎপাদনের শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের ৯১ শতাংশ ধানের ফলনে ভূমিকা রাখছে।
তবে সবজির বীজ উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণে শীর্ষে আছে দেশের বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএআরআই) ১২০টি সবজির ভ্যারাইটির সাথে বিভিন্ন ফসলের ৫৪৫ টি উচ্চ ফলনশীল বীজের সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু তারপরও দেশে মানসম্পন্ন বীজের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না।
জানা গেছে, দেশে সবজির বীজের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে মানসম্পন্ন বীজ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫০ শতাংশ। এই ৫০ শতাংশের মধ্যে সরকারি অবদান মাত্র ২ শতাংশ। বাকি চাহিদা আমদানি ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের মাধ্যমে পূর্ণ হয়ে থাকে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩০ শতাংশ বীজের সরবরাহ লাল তীর থেকে আসছে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া দেশের বাজারে বীজ উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এসিআই, ব্র্যাক, মেটাল এগ্রো, সুপ্রিম সীড ইত্যাদি। মোট চাহিদার ২০ শতাংশ বীজ আমদানি করা হয়ে থাকে।
বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টন সবজির বীজের চাহিদা থাকে। এর বড় অংশই উচ্চ ফলনশীল জাতের।
এর মধ্যে লাল তীর প্রতি বছর প্রায় ১,০০০ মেট্রিক টন বীজ সরবরাহ করছে, যার ৮৫ শতাংশই হাইব্রিড।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. গোলাম রব্বানি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডর্ডকে বলেন, বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন বীজ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে এদের মধ্যে লাল তীরকে অগ্রগামী বলতে হবে। সবজির বীজ উৎপাদনে তারা সবচেয়ে এগিয়ে আছে।"
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে চুক্তি করেছে লাল তীর সিড লিমিটেড। চুক্তির ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত বীজের উৎপাদন ও গবেষণা পরিচালনা পারবে।
প্রতিষ্ঠানটি সারা বছর গবেষণার পাশাপাশি ১,০০০ টন সবজি ও ১,৫০০ টন ধানের বীজ উৎপাদন করে থাকে।
লাল তীরের পরিচালক তাফসীর এম আওয়াল টিবিএসকে বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি খাতে। অন্যদিকে চাষের জমিও প্রতিনিয়ত কমছে। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন প্রজাতির উদ্ভাবনে কাজ করছি আমরা।'
লাল তীরের গবেষণা ও বীজ বিতরণ কেন্দ্র
গাজীপুরের বসনে ৪০ একর জায়গার উপর লাল তীরের প্ল্যান্ট এবং আরএন্ডডি ফার্ম অবস্থিত। এখানে বীজের প্যাকেজিং, মান যাচাই, বিতরণ থেকে শুরু করে সব কাজই চলে। বীজের পাশাপাশি প্ল্যান্টে নানা ধরনের সবজির গাছও লাগানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জার্মিনেশন সেন্টারে কোন নমুনার ৮০ ভাগ বীজ গজালে তবেই সেটাকে বাজারজাত করার অনুমতি দেয় লাল তীর।
গবেষণা এবং বীজ বিতরণ সেন্টার শত শত প্রজাতির সবজি নিয়ে কাজ করে। এদের মধ্যে আছে টমেটো, মূলা, ফুলকপি, সরিষা, বেগুন, কাঁচা মরিচ, করলা সহ নানা সবজির গাছ। প্রতিটি ফসলের ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য রয়েছে আলাদা গবেষণাগার।
লাল তীরের জেনারেল ম্যানেজার ডক্টর এম এ রশিদ বলেন, 'গবেষণার কারণেই লাল তীর অন্যদের থেকে আলাদা। আমাদের উদ্ভাবিত নতুন জাতের বীজ খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।"
ভালুকায় ৫০ একর জমির উপর ফলন বৃদ্ধি ও উন্নতকরণের লক্ষ্যে ধানের উপর বিশেষায়িত গবেষণা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
লাল তীর দুধ ও মাংসের সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত জাতের বাছুর এবং মহিষের উপরেও কাজ করে চলেছে।
দেশের বাইরে থেকে গুঁড়াদুধ এবং দুধের আমদানি কমানোর লক্ষ্যে পশুসম্পদের উপর গবেষণা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।