কোভিড-১৯ টিকা স্বল্প আয়ের দেশগুলো কখন ও কীভাবে পাবে?
উচ্চ-আয়ের দেশে দিন দিন বেগবান হচ্ছে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি। কিন্তু, বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সেই তুলনায় অন্ধকারে ঢাকা। মধ্য-আয়ের কিছু দেশে সীমিত সংখ্যায় উদ্যোগটি শুরু হলেও, ব্যাপক মাত্রায় টিকাদানে এখনও এক বছরের বেশি সময় দেরির শঙ্কা রয়েছে।
প্রথম দুটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পায়। টিকাদুটির প্রথমটি ছিল; ফাইজার/ বায়োএনটেক এর তৈরি। দ্বিতীয়টি প্রস্তুতকারক সংস্থা মডের্না ইঙ্ক। এগুলো স্বল্প-আয়ের দেশে বিতরণের সহযোগী নয়।
ফাইজারের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতি-শীতল তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্যেয দরকারি অবকাঠামো কোনো মধ্য ও স্বল্প আয়ের দেশেই নেই। তাছাড়া, দামের বিষয়টি তো আছেই। প্রতি ডোজের ন্যূনতম মূল্য ২০ মার্কিন ডলার, তাতে দুই ডোজ কেনার খরচ পড়বে ৪০ ডলার।
সেই তুলনায় মডের্না আবিষ্কৃত টিকা সাধারণ ফ্রিজারের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা গেলেও, এর দাম আরো বেশি। স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলো অবশ্য সীমিত পরিমাণে টিকাদুটি কেনার সরাসরি কিছু চুক্তি করতে পেরেছে। কিন্তু, সমস্যা আছে সেখানেও।
চুক্তি হলেও প্রধান সমস্যা টিকার সহজলভ্যতা। ধনী দেশগুলো এসব টিকার বাড়তি চালান অগ্রিম কিনে রেখেছে। সেই তুলনায় সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার জন্য মাত্র ৫ কোটি ডোজ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে ফাইজার। সেটাও দেওয়া হবে চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মেয়াদে। অন্যদিকে, আফ্রিকার জন্য আলাদা করে বিক্রির কোনো অঙ্গীকার করেনি মডের্না। তাই দিন যত যাচ্ছে, বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চল টিকা ছাড়াই থাকবে, এমন শঙ্কাও ঘনীভূত হচ্ছে।
কোভিড-১৯ টিকা স্বল্প আয়ের দেশসহ সকলে যেন সমতার ভিত্তিতে পায় সেজন্য কোভ্যাক্স উদ্যোগ নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। এজন্য সংগ্রহ করা হয় ২৪০ কোটি ডলারের তহবিল। আর চুক্তি অনুসারে তহবিল থেকে কিনে ১৩০ কোটি ডোজ উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশে সরবরাহ করা হবে।
কিন্তু, এপর্যন্ত শুধু ফাইজার ভ্যাকসিনকে জরুরি ব্যবহারের স্বীকৃতি দিয়েছে হু'। কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে বন্টনের জন্য হু'র অনুমোদন আবশ্যক। পশ্চিমা বিশ্বের আবিষ্কৃত তৃতীয় টিকাটি যৌথভাবে প্রস্তুত করেছে অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর দাম তুলনামুলক ভাবে সস্তা এবং সংরক্ষণ করাও সহজ। এটি ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদনে বৃহৎ কিছু প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গেও চুক্তি করা হয়। সেখান থেকে এটি কোভ্যাক্স উদ্যোগেও সরবরাহ করার কথা। কিন্তু, টিকাটিকে এখনও অনুমোদন দেয়নি হু'।
হু' ইতোপূর্বে জানায়, চলতি জানুয়ারির শেষ নাগাদ কোভ্যাক্স থেকে প্রথম ধাপের ভ্যাকসিন চালান সরবরাহ করা হবে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ তারা বিশ্বব্যাপী টিকার ২শ' কোটি ডোজ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়েছে।
এই লক্ষ্য কঠিন, কিন্তু তা পূরণ করা সম্ভব হলেও; সেটা বিশ্বের চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট নয়। সমগ্র আফ্রিকান ইউনিয়নের পক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "ফেব্রুয়ারি এবং জুনে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যতগুলো ডোজ পাওয়া যাবে; তা দিয়ে শুধু সম্মুখভাগের স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকাদান সম্ভব। ফলে আফ্রিকায় ক্রমশ বেড়ে চলা মহামারীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।"
তিনি উল্লেখ করেন, কোভ্যাক্স আফ্রিকাকে সর্বমোট যে পরিমাণ ডোজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে- তা দিয়ে মাত্র ৩০ কোটি লোক বা মহাদেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব।
অপেক্ষায় বসে না থেকে কোভ্যাক্স'কে এড়িয়ে করে সরাসরি উৎপাদক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে উচ্চ-আয়ের দেশসমূহ। হু'র উদ্যোগ ত্যাগ করে তাদের কাতারে একে একে এসে যোগ দিচ্ছে আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, দ. আফ্রিকা এবং তুরস্কের মতো মধ্য-আয়ের দেশ। অবশ্য, পশ্চিমে উৎপাদিত টিকা নয়; বরং তারা ভিন্ন ধরনের পন্য যেমন; ভারত, চীন ও রাশিয়ায় উৎপাদিত টিকা সংগ্রহে উদ্যোগ নিচ্ছে।
ভারতের পুনে ভিত্তিক সেরাম ইনস্টিটিউড অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদক সংস্থা। তারা অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছে। স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক ভারত বায়োটেক-ও সরকারি সহায়তায় স্থানীয়ভাবে একটি টিকা আবিষ্কার করেছে। গত তিন জানুয়ারি প্রতিষেধক পণ্য দুটির জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ভারতীয় ওষুধ প্রশাসন। আর গত ১৬ জানুয়ারি থেকে দেশটিতে টিকা দুটি দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়।
ভারত তাদের উৎপাদিত টিকা অন্যদেশে সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই, প্রতিবেশী বাংলাদেশ অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে এবং সেরামের সঙ্গে ৩ কোটি ডোজ ক্রয়ের প্রাথমিক চুক্তি করেছে। অন্যদিকে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ ভারত থেকে ১০ লাখ ডোজ কেনার কথা জানিয়েছে দ. আফ্রিকা। ফেব্রুয়ারিতে আরও পাঁচ লাখ ডোজের চালান পাওয়া যাবে, বলেও জানিয়েছে দেশটি।
আফ্রিকান ইউনিয়নকে ২৭ কোটি ডোজ সরবরাহের অঙ্গীকার করা তিনটি সংস্থার একটি হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউড। জুন নাগাদ তাদের মোট ৫ কোটি ডোজ সরবরাহ করার কথা। সংস্থাটি কোভ্যাক্সকেও সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু তারা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনকে হু'র স্বীকৃতি দেওয়ার অপেক্ষা করছে।
মহামারীর প্রথম কয়েক মাসে টিকা সরবরাহ নিয়ে লুকোচুরির করলেও, এবার টিকা দিয়ে কূটনীতি বন্ধন জোরদারে তৎপর হয়েছে চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনে আবিষ্কৃত টিকাগুলোকে বিশ্ব নাগরিকের কল্যাণে নিয়োজিত করার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় টিকা ক্রয়ে আর্থিক সহয়তার প্রস্তাবও দেন।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা সাইনোফার্মের তৈরি কোভিড-১৯ টিকার সাধারণ ব্যবহারকে অনুমোদন দেয় চীন। কোম্পানিটি চলতি ২০২১ সালের শেষ নাগাদ শত কোটি ডোজ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে। এই টিকাকে ইতোমধ্যেই, জরুরি প্রয়োগের স্বীকৃতি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন এবং মরক্কো। অন্যদিকে, মিশর এবং পাকিস্তান যথাক্রমে এর ১ কোটি এবং ১২ লাখ ডোজ ক্রয়ের চুক্তি ঘোষণা করেছে।
চীনেরই অপর সংস্থা সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক নামে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে টিকাদান শুরু করেছে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া। অচিরেই, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন এ টিকাটি দেওয়া শুরু করবে। দ. আমেরিকা মহাদেশের বৃহত্তম দেশ ব্রাজিলের সাও পাওলো অঙ্গরাজ্য করোনাভ্যাকের ৪ কোটি ৬০ লাখ ডোজ ক্রয়ে সম্মত হয়ে, ইতোমধ্যেই নিজ দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম টিকাদান শুরু করেছে।
বিশ্বের সর্বপ্রথম কোভিড-১৯ টিকা অনুমোদন দেওয়া দেশ রাশিয়া। ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে তারাও অগ্রগামী। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে তৈরি দেশটির স্পুটনিক-ভি প্রতিষেধক গেল বছরের ১১ আগস্ট জরুরি অনুমোদন লাভ করে। গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে স্পুটনিক-ভি টিকাদান শুরু করে আর্জেন্টিনা। এছাড়া, গায়ানা ও সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে প্রথমদিকে যেসব টিকা পাওয়া যাবে, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবে রাশিয়ায় তৈরি ভ্যাকসিনটি।
স্পুটনিক-ভি উৎপাদনে হেটেরিও ড্রাগসসহ ভারতের একাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে রাশিয়া। তুরস্কের সঙ্গেও এটি উৎপাদনের চুক্তি হয়েছে। এছাড়া, ব্রাজিলের বাহিয়া রাজ্য ৫ কোটি ডোজের বিনিময়ে টিকাটির তৃতীয় ট্রায়াল শুরুর অনুমতি দিয়েছে।
অর্থাৎ, হু' উদ্যোগের বাইরে গিয়েই মধ্য-আয়ের দেশগুলো চালান ভিন্ন উৎস থেকে পাচ্ছে এবং টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পদক্ষেপ জোরদার করছে। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্ব সংস্থাটির নিরাপদ অনুমোদন ও চালানের মান পরীক্ষার প্রক্রিয়াও বাদ যাচ্ছে। সম্পূর্ণ টিকাহীন থাকা এবং বিভিন্ন সংস্থার টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞ মহলের উদ্বেগের মধ্যেই চলছে এমন পদক্ষেপ। তাছাড়া, হু'র অনুমোদনে দেরি নিয়েও সংস্থাটির উপর আস্থা রাখতে পারছে না অনেক দেশ।
কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে পুরো বিশ্বে পর্যাপ্ত সংখ্যায় টিকার ডোজ বিতরণের বিকল্প নেই। আর তা করতে হলে; ভারত, চীন এবং রাশিয়ায় উৎপাদিত টিকাগুলোকে 'সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ফলপ্রসূ' হওয়ার ছাড়পত্র পেতে হবে। শুধু মধ্য-আয়ের দেশ নয়, সরবরাহ বাড়াতে হবে স্বল্প আয়ের দেশে। তাছাড়া, বর্তমানে আবিষ্কৃত টিকাগুলো অকার্যকর করে দেওয়ার মতো করে সার্স কোভ-২ জীবাণু অভিযোজিত হবে, এমন উদ্বেগ নিয়েও সতর্ক থাকা দরকার। এক্ষেত্রে, দরিদ্র দেশের টিকা প্রাপ্তিতে যত দেরি হবে, জীবাণুর নতুনতর ও শক্তিশালী ধরন বিকাশের ঝুঁকি ততোই বাড়বে।
বৈশ্বিক টিকাদানের গুরুত্ব এবং সেই কাজের পর্বত-প্রমাণ চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু, উৎপাদন সক্ষমতায় হয়তো সময়ের দৌড় সবচেয়ে বড় বাধা। সুবিশাল উৎপাদন সক্ষমতা নিয়েও আগস্ট নাগাদ ৩০ কোটি মানুষকে টিকা দিতে চায় ভারত। অর্থাৎ, টিকা পাবেন মোট জনসংখ্যার চারভাগের এক ভাগেরও কম। এব্যাপারে সঠিক কথাটি বলেন সেরামের মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়াল্লা। তার ভাষায়, "এই পৃথিবীর সকল মানুষ না হলেও, অন্তত ৯০ শতাংশকেও টিকার আওতায় আনতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।"
- সূত্র: রয়টার্স