করোনায় ঘ্রাণ হারিয়ে রান্নায় সৃজনশীল!
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ডা. অ্যালেক্স ইয়েটস মহা উৎসাহে এক মুখরোচক ডিনার তৈরি করে তার স্ত্রীর সামনে নিয়ে যেতেই তিনি যেন আঁতকে উঠলেন।
"এটা ছিল উপরে আলমন্ড এবং হলুদের গুঁড়ো ছিটানো ব্ল্যাক বিন পাস্তা। দেখতে এত জঘন্য লাগল যে, বলেই উঠলাম, 'আমি এ জিনিস খাচ্ছি না'," বলেন ৩১ বছর বয়সী সেবিকা সারাহ ইয়েটস।
এই দম্পতি ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিলে একটি হাসপাতালে কর্মরত। সেখানেই আগস্টে সারাহ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হন এবং ভাইরাসটি বাড়ি বয়ে নিয়ে আসেন!
কোভিড আক্রান্ত অন্যদের মতোই তারা দুজন ধীরে ধীরে খেয়াল করেন, ঘ্রাণ ও স্বাদ গ্রহণের বোধ হারিয়ে ফেলছেন।
মুরগির মাংসের টুকরোয় লেবু চিপলে যে গন্ধ বেরোয় কিংবা স্যুপ-সালাদে একমুঠো মসলা ছিটানোর পরের ঝাঁজ- কিছুই তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে অনুভব করতে পারেননি।
কিন্তু যেদিন থেকে সারাহ বুঝলেন পাস্তার ওপরে ভেসে থাকা হলুদ গুঁড়োকে তিনি আর যাই হোক, 'খাবার' হিসেবে গ্রহণ করতে পারছেন না, বুঝলেন- খাবারে স্বাদ ফিরে আসছে তার!
এনসমিয়া বা 'ঘ্রাণের অন্ধত্ব'- কোভিড আক্রান্তদের জন্য এক অতি সাধারণ উপসর্গ, যার ফলে তারা ঘ্রাণ ও স্বাদ গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়েন।
সিএনএনের মেডিকেল অ্যানালিস্ট ডা. লিয়ানা ওয়েন বলেন, 'কোভিড সংক্রমণের একদম প্রথম দিকে প্রকাশ পাওয়া লক্ষণগুলোর ভেতর অন্যতম হলো ঘ্রাণ ও স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি লোপ পাওয়া।'
'এমনকি রক্ত জমাট বাঁধাসহ আরও অনেক লক্ষণ বোঝা না গেলেও এটি এক প্রকট উপসর্গ,' বলেন তিনি।
লিয়ানা আরও বলেন, 'বেশিরভাগ রোগীই নিরাময়ের কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের ভেতর তাদের ইন্দ্রিয়ক্ষমতা ফিরে পেলেও কারও কারও আবার মাসের পর মাস ঘ্রাণ বা স্বাদ গ্রহণ ক্ষমতা ফেরে না।'
কিন্তু মানুষের তো খেতেই হবে, তাই তারা খাবারকে নানাভাবে রূপান্তর করতে শুরু করলেন!
খাবারে নতুন নতুন স্বাদ (ফ্লেভার) যোগ
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি করোনা শনাক্তের কয়েকদিন পরই এলথিয়া মালারকি (৫৩) অবাক হয়ে দেখলেন, তিনি তার শ্যাম্পুর কড়া গার্ডেনিয়া সুগন্ধটা আর অনুভব করতে পারছেন না।
বিস্ময়ে তিনি পুরো বাড়ি মাথায় করলেন; সামনে যা পেলেন সব শুঁকতে লাগলেন। অচিরেই বুঝলেন, তার ঘ্রাণশক্তি লোপ পেয়েছে।
নিউইয়র্কের হাডসন ভ্যালিতে বসবাসরত, নিজেকে 'ভোজনরসিক' হিসেবে দাবি করা এই নারী জানান, মুখভর্তি পছন্দের ডিমের ডিশ খেতে আর কোনো ইচ্ছা তার হলো না; কারণ ডিমের স্বাদটাই তিনি আর বুঝতে পারছিলেন না। ভীষণ প্রিয় ব্লু-চিজ চেখে দেখার ইচ্ছেটাও মরে গেল একই কারণে।
এখন মালারকির সকালের নাস্তা আগেরদিনের বাসি খাবার! দুপুরে কোনোমতে লেবু চিপড়ানো হামাস, শুকনো অলিভ ও মশলাদার তেল সহযোগে নান খেয়ে লাঞ্চ সারেন।
'আমি এখনো লবণ, লেবু আর মসলার স্বাদ পাই; খাবারের মচমচে ভাবটা আমার ভালো লাগে,' বলেন মালারকি। কিন্তু তিনি রান্নাঘরে যেভাবে খাবারের রেসিপি নিয়ে একটার পর একটা পরীক্ষা চালাতেন, তা আর এখন হয়ে ওঠে না।
'খাবার গ্রহণকালীন কিছু সংবেদনশীল অনুভূতি কোভিডের পরেও সক্রিয় থাকে। ঝাঁঝালো মশলা, পুদিনার স্বাদ ইত্যাদি মুখের গরম ও ঠাণ্ডা অনুভবের সেন্সর দিয়ে বোঝা সম্ভব। আপনি অম্ল, উত্তাপ, এমনকি লবণাক্ততাও বুঝবেন হয়তো; কিন্তু একই খাবারে উপস্থিত বিভিন্ন স্তর বুঝবেন না,' বলেন কোভিড-১৯ রোগীদের বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে কাজ করা ডা. মারতা বেকার।
তিনি বলেন, 'চিজ, ফলমূল, চকলেট বা কফির মতো খাবারগুলোর স্বাদের যে বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা সেগুলোকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারি, তা মুখ দিয়ে নয়, জেনে অবাক হবেন, আমরা এসবের স্বাদ নিয়ে থাকি মূলত নাক দিয়ে।'
হয়তো এজন্যই খাবারের টেক্সচার, রঙ, এমনকি খাবারটি তৈরির পদ্ধতি পর্যন্ত কিছু মানুষের কাছে এই মহামারির সময়টিতে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সারাহ বলেন, 'আমি চেষ্টা করি, খাবারে প্রচুর সবুজ রাখতে। সাদা ও ধূসর রঙা খাবার আমার কাছে কোনো আবেদন তুলে ধরে না এখন আর।'
খাদ্যাভ্যাসের এসব পরিবর্তনের ফলে এখন তিনি আগের চেয়েও খাবার প্রস্তুতির পেছনে অধিক সময় ও মনোযোগ দিয়ে থাকেন।
অদ্ভুতুরে গন্ধ যখন ভালো কিছু
অনলাইনের কোভিড-১৯ সাপোর্ট গ্রুপগুলোর আলোচনার সাধারণ একটা বিষয় হলো, এই উৎকট ও অদ্ভুতুরে গন্ধ।
কোভিড শনাক্তের মাস পার হলেও, কেউ কেউ চুরুট, জেট জ্বালানি বা সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পান; অথচ আশেপাশে এমন কিছুর অস্তিত্বই থাকে না।
মালারকি জানান, তিনি একবার এত তীব্র ধোঁয়া ও ছাইয়ের গন্ধ পেয়েছিলেন, রীতিমতো গলা ধরে এসেছিল তার।
তবে ডা. বেকারের কাছে এটিই এক সম্ভাবনাময় সংবাদ!
'আমার অনেক রোগীই বলেন, তারা পচা আবর্জনার গন্ধ থেকে শুরু করে রাবার পোড়ানোর গন্ধ পর্যন্ত পান। এটা যেমন চিন্তার বিষয়, তেমনি আশারও কথা,' বলেন বেকার।
যদিও ঠিক কী কারণে মানুষ কোভিড আক্রান্ত হলে ঘ্রাণ বা স্বাদের অনুভূতি হারায়, সেটি এখনো অজানা। ওয়েন বলেন, 'ভাইরাসটি ঘ্রাণ নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুকোষে কোনো প্রভাব না ফেললেও এর আশেপাশের সহায়ক কোষগুলোর ওপর এক ধরনের প্রভাব রাখে।'
এটাই সুখবর। কারণ নিউরন বা স্নায়ুকোষের চেয়ে এসব সহায়ক কোষ দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হয়।
'যখন কোষগুলো নতুন করে উৎপত্তি লাভ করে, তখন পূর্বের অবস্থা ফিরে পেতে কিছুটা সময় লেগে যায়,' বলেন তিনি।
হয়তো সেজন্যই একবার ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি হারাবার পর তা ফিরে পেতে সময় লাগে।
প্রশিক্ষণে মিলবে সহায়তা
'রান্নার সময় খাবারের সুঘ্রাণ নেওয়ার স্মৃতি আমাকে কাতর করে তোলে। যদিও অনেক স্বাদ পাই না, তবু খাবারে সামান্য লেবুর রস বা লবঙ্গ এবং অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত মশলার আবেশ আমাকে অনুভব করায়, আমি খাবারে কিছু মিস করছি না,' বলেন লন্ডনবাসী ২৮ বছরের তরুণী কায়া চেশায়ার।
তিনি আরও জানান, ঘ্রাণশক্তি পুরোপুরি ফিরে পেতে প্রয়োজনে পাঁচবার কোভিডে আক্রান্ত হতে রাজি আছেন!
ডাক্তারের পরামর্শে কায়া বর্তমানে 'ঘ্রাণ প্রশিক্ষণ' নেওয়া শুরু করেছেন। গোলাপ, লেবু, লবঙ্গ, রসুন, ইউক্যালিপটাস ও কর্পুরের মতো তীব্র গন্ধযুক্ত বিভিন্ন দ্রব্যের সাহায্যে এ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তিনি।
কায়া বলেন, 'আমি চিন্তা করি, এক সময় জিনিসগুলোর সুঘ্রাণ কেমন ছিল; আমি চেষ্টা করি সেই জিনিসের সুগন্ধ মনে রাখার, যেন আরেকবার সামনে এলে চিনতে পারি।'
এদিকে, ডা. বেকার বলেন, 'যেহেতু এনসমিয়ার আপাতত কোনো প্রতিকার নেই, তাই আমি এখন এসব কৌশলের কথা রোগীদের জানিয়ে দিই।'
'কীভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো জিনিসের গন্ধ মনে রেখে ঘ্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে, তা কিছুটা রহস্যজনক। স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে নিউরনের পুনরুদ্ধারের এ প্রক্রিয়া দ্বিমুখী। স্মৃতি আপনাকে সুঘ্রাণ নিতে সাহায্য করে, বিপরীতে সুঘ্রাণ আপনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে,' বলেন তিনি।
বেকার আরও বলেন, 'তবে এজন্য আপনাকে কোনো বিলাসী এসেনশিয়ালস ওয়েল এনে চর্চা করতে হবে না। আপনার আশেপাশে থাকা জিনিসগুলোর সাহায্য নিন, যেগুলোর গন্ধ আপনার স্মৃতিতে রয়ে গেছে।'
সারাহ ইয়েটস এখন অনেকটাই তার স্বাদ ও গন্ধ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি এখন এমন খাবার তৈরি করি, যা দেখতে সুন্দর, পাশাপাশি স্বাদেও বৈচিত্র্যময়।'
তার স্বামী অ্যালেক্সের জন্যও এসব ডিশ স্মৃতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
'আমার মনে আছে, এটি স্বাদে ও গন্ধে কেমন; আমি সেভাবেই চিন্তা করি এবং এটি আমার স্মৃতি ফেরাতে সাহায্য করে,' বলেন অ্যালেক্স।
- সূত্র: সিএনএন