পাঠদানের শুরুতে শিক্ষক সংকটের আশঙ্কা
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে রয়েছে ১,৬০০ জন শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৫০। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতি ক্লাসে দ্বাদশ শ্রেণির ৩৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। তবে, দশম শ্রেণির ক্লাসরুমগুলো ছোট হওয়ার ধারণক্ষমতা ২৭ জনের।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ এক বছর বন্ধ থাকার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি খুলতে চলেছে। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস চলবে। প্রতিটি বিষয় পড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটির ৩৮ জন শিক্ষকের প্রয়োজন।
ভাইস প্রিন্সিপাল (পরীক্ষা ও সমন্বয়) দেওয়ান মোহাম্মদ তামজীদুজ্জামান বলেন, 'সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস চললে প্রতি বিষয়ে ৭৬ জন শিক্ষকের প্রয়োজন পড়বে।'
কিন্তু কলেজে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের জন্য যথাক্রমে মাত্র ১৯ ও ১৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষকের সংখ্যা আরও কম।
'সরকার যদি প্রতিদিন ক্লাস করানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে শিক্ষক সংকট শুরু হবে এবং দুঃখজনকভাবে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে,' বলেন তামজীদুজ্জামান।
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিদিন ক্লাস পরিচালনার বিষয়ে আমরা চিন্তিত। তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঠদানের সর্বোত্তম চেষ্টা করব।'
'সংকট কাটাতে আমরা নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে পারি। কিন্তু ভালো ও দক্ষ শিক্ষকদের সংখ্যা কম হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়াও বেশ কঠিন,' যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত উদ্বেগজনক। দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি বেশ নাজুক।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক ও ছাত্রের অনুপাত যথাক্রমে ১:৩৭ ও ১:৪৫। তবে শিক্ষাবিদদের মতে, প্রাথমিকে এই হার ১:৩০ হওয়া উচিত। অন্যদিকে, মাধ্যমিকে আদর্শ অনুপাত ১:২০।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন স্বাভাবিক (নিউ নরমাল) অবস্থায় শিক্ষক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের সম্ভাবনা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তারা।
তবে এখন পর্যন্ত সংকট এড়াতে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা সরকারের নেই।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি এবং টিকাদান কর্মসূচী শুরু হওয়ায় সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা করছে।
প্রতিষ্ঠান খোলার পর দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নিয়মিত ক্লাস চলবে।
অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একদিন সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাস করতে হবে। সেখানে পুরো সপ্তাহের জন্য বাড়ির কাজ দেওয়া হবে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো বেঞ্চ পাঁচ ফুটের কম হলে সেখানে শুধু একজন শিক্ষার্থী বসতে পারবে। তবে বেঞ্চের দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুটের বেশি হলে দুই প্রান্তে দুজন শিক্ষার্থী বসতে পারবে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, শিক্ষাদানকে কার্যকর করে তুলতে তিনি সরকারকে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দেখেননি।
'দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র শিক্ষক সংকট চলছে। একাডেমিক কার্যক্রমেও এর প্রভাব পড়বে। এখানে পরিকল্পনা ও প্রণোদনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে,' বলেন তিনি।
'সামনের দিনগুলোতে শিক্ষাখাতের জন্য সরকারি অর্থায়নের প্রয়োজন। তবে দুঃখজনক হলেও, আমরা কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। সরকারের এখন নতুন ধারার শিক্ষা কার্যক্রমে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবা উচিত,' বলেন অধ্যাপক মনজুর।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, "আমরা স্কুল ও কলেজগুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের কথা বলে আসছি। এমনকি জাতীয় শিক্ষা নীতিতে 'জাতীয় শিক্ষক নিয়োগ কমিশন' গঠনের পরামর্শও দিয়েছি। তবে সরকার আমাদের দাবির বিষয়ে নজর দেয়নি।"
ইতোমধ্যে, শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্লাসরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা শুরু করেছে। ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত স্বাস্থ্য নির্দেশনা মোতাবেক সব মানা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য নীতিমালাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক তৈরি করা হয়েছে।
দিনাজপুর কালেক্টোরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল রাহিনুল ইসলাম সিদ্দিক জানান, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস খোলার ব্যাপারে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তবে তিনি এখন শিক্ষক স্বল্পতা নিয়ে চিন্তিত।
তিনি বলেন, 'আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুধু আমাদেরই নয়, অধিকাংশ স্কুলেরই সীমিতসংখ্যক শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে সমস্যা হবে। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ক্ষতিপূরণও যথাযথভাবে হবে না।'
প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশে প্রায় দুই লাখ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ও ২০ লাখের অধিক শিক্ষক রয়েছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের নিশ্চয়তাদানের বিষয়ে প্রশাসন চিন্তা করছে। 'আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিব,' বলেন তিনি।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় তার প্রতিষ্ঠান বৃহৎ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা বেশ কঠিন হবে।
তিনি বলেন, 'শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে এখন শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা দরকার। তা না হলে একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে।'
'আমাদের ক্যাম্পাস ও ক্লাসরুমগুলো ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে। আমরা এখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা করছি,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৭ সালের তথ্যানুযায়ী, এমপিওভুক্ত ৮০ শতাংশ এবং এমপিওহীন ৩৩ শতাংশ বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের কার্যক্রম আধা-পাকা ঘরে হয়ে থাকে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে টয়লেট ও শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাত ১:৪১। অন্যদিকে, এমপিওহীন বেসরকারি স্কুলগুলোতে এই অনুপাত ১:৬১।
গত বছর ১৬ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৮ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মহামারিতে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা বিবেচনায় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোচিং সেন্টার বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
পরবর্তীকালে ৯ এপ্রিল, ২৫ এপ্রিল, ৫ মে, ৩০ মে, ৬ আগস্ট, ৩১ আগস্ট, ৩ অক্টোবর, ৩১ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ১৯ ডিসেম্বর, ১৬ জানুয়ারি, ৩০ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
স্কুল বন্ধ হবার পর থেকে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও, ধীরে ধীরে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়।
এর আগে সরকার করোনা মহামারির জন্য গত বছর পিএসসি, জেএসসি, এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পিএসসি ও জেএসসি পরিক্ষার্থীরা সরাসরি পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে। তবে এইচিএসসি শিক্ষার্থীদের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এছাড়া, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের সকল শিক্ষার্থীদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।