সড়কবাতির দাম কত?
এক দশক ধরে চলমান দুটি প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে অস্বাভাবিক উচ্চ দামে এলইডি বাতি স্থাপনের প্রস্তাব করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। একটি প্রকল্পে প্রতিটি লাইট স্থাপনে সিডিএ ব্যয় প্রস্তাব করেছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আরেকটিতে ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
এলইডি বাতি স্থাপনের এই দর প্রস্তাব দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে একটি প্রকল্পে বাতিপ্রতি ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব একনেকে অনুমোদিতও হয়েছে। আরেকটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
যে দুটি প্রকল্পের জন্য অস্বাভাবিক এই উচ্চ দামে এলইডি বাতি কেনার প্রস্তাব, তার একটি চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড নির্মাণ প্রকল্প। দ্বিতীয়টি ঢাকা ট্রাংক রোড থেকে বায়েজিদ বোস্তামী রোড পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের বহিঃসীমানা দিয়ে একটি ইউলুপও নির্মাণ করা হবে।
আউটার রিং প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব ইতোমধ্যেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পেয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবটি নিয়ে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে শুরু করা এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে। পরে প্রকল্পের মেয়াদ চার দফায় আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।
মূল প্রকল্প প্রস্তাবে ১৪৫টি স্ট্রিট লাইট (সড়কবাতি) কেনা ও স্থাপনে ৬৯.৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত প্রস্তাবে লাইটের সংখ্যা ২৪০টি করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
মূল প্রকল্পে প্রতিটি লাইট কেনা ও স্থাপনে ব্যয় ধরা ছিল ৪৮ হাজার ১৩১ টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে লাইটপ্রতি ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকারও বেশি। লাইটপ্রতি বৃদ্ধি প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ।
মূল প্রকল্পে ১১৫টি বৈদ্যুতিক পোল অপসারণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সংশোধিত প্রস্তাবে পোলের সংখ্যা না দেখিয়ে থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
মূল প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৭৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আরও ছয় মাস সময় চেয়ে সম্প্রতি সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি টাকারও বেশি।
সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৫০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হয়েছে। জমির ক্ষতিপূরণ, রোড মার্কিং ও ডিভাইডার নির্মাণেও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। এর পরেও সংশোধনীতে বাড়তি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাবে সিডিএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাহাড়ি এলাকা বিবেচনায় রাস্তার দুই পাশে ২৫ মিটার দূরত্বে এলইডি লাইট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় ব্যয় বাড়ছে।
প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পাহাড় কাটার অনুমতি পেতে দেরি হয়। মূলত এ কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। আগামি ছয় মাসে বাস্তবায়ন কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'পাহাড়ি সড়কের এলাকাটি নির্জন। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভালো মানের এলইডি লাইটের প্রস্তাব করায় ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। আমরা যে এলইডি বাতি স্থাপন করতে চাচ্ছি, সেগুলো জার্মানির তৈরি। এসব বাতি বেশি আলো দেয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির কারণে বিশ্বব্যাপী এলিইডি বাতির দাম কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো।
তিনি বলেন, বেশি আলো পাওয়ার জন্য সড়কে শক্তিশালী বাতি ব্যবহার করার কথা কেউ বললে বুঝতে হবে তিনি ভুল বলছেন। কারণ সড়কে সব সময় পরিমিত আলো ব্যবহার করতে হয়। উচ্চমাত্রার আলো সড়কে দুর্ঘটনা বাড়াতে পারে।
আউটার রিং রোড প্রকল্পের প্রতি এলইডির খরচ প্রায় ২.৭১ লাখ টাকা
৮৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ২০১১ সালে নেওয়া চিটাগাং আউটার রিং রোড নির্মাণ প্রকল্পের কাজ গত এক দশকেও শেষ হয়নি। চার দফায় মেয়াদ বৃদ্ধির পর ২৬৭৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে সম্প্রতি প্রকল্পটির সংশোধনী একনেকে অনুমোদিত হয়।
শেষ পর্যায়ে এসে প্রকল্পে নতুন করে যোগ হওয়া ১.৭৫ কিলোমিটার সিইপিজেড সড়কে ৭০টি এলইডি বাতি স্থাপন করতে ১.৮৫ কোটি টাকা চেয়েছে সিডিএ। এতে প্রতি বাতিতে ব্যয় হবে প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
মূল প্রকল্প প্রস্তাবে অন্যান্য সড়কে ২৮৩টি বাতি স্থাপনে ৩.১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধনীতে বাতির সংখ্যা ১১০-এ নামিয়ে এনে ২.৯৮ কোটি টাকা চেয়েছে সিডিএ। তাতে দেশের সবচেয়ে দামি এই এলিইডি বাতির প্রতিটির দাম পড়ছে প্রায় ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা। মূল প্রকল্পের চেয়ে সংশোধনীতে এলইডিপ্রতি দাম বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
এর আগেও এলইডি বাতিতে বাড়তি বরাদ্দ নিয়ে আলোচিত হয়েছে সিডিএ। সংস্থার কনস্ট্রাকশন অব নর্থ-সাউথ রোড-১ প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতি কেনা ও স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮২০ টাকা।
যদিও গত বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের 'মডার্নিসেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়াস আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন' প্রকল্পে প্রতিটি বাতি স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৫০ টাকা।
এদিকে, 'ডেভেলপমেন্ট অব ডিফারেন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচারস আন্ডার দ্য ঢাকা সাউথ সিটি করপোরেশন (সেকেন্ড রিভাইজড)' প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি এলইডি বাল্ব ক্রয় ও স্থাপনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৬৪ হাজার ৮৫৫ টাকা খরচ করবে।