সঠিক সময়ে টিকাদানে ব্যর্থতার মূল্য ৯ লাখ কোটি ডলার
ধনী দেশে জোরগতিতেই চলছে টিকাদানের উদ্যোগ। সেই তুলনায় পিছিয়ে আছে কম আয়ের দেশগুলো। কিন্তু, দরিদ্র দেশে টিকাদানের গতি স্তিমিত হলে তাতে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা থেকে উত্তরণ। এমনকি মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পথ থেকেও বিচ্যুত হতে পারে বিশ্ব।
ব্লুমবার্গ ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অনুসারে, গত সপ্তাহে পৃথিবীর নানা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডোজ দেওয়া হয়। কিন্তু, তা সকল দেশের ক্ষেত্রে সমান ছিল না মোটেও। মোট ডোজের ৪০ শতাংশ বা ১১ কোটি ৯৮ লাখ দেওয়া হয় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে।
উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলো, সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আফ্রিকায় টিকাদান শুরু করেছে শুধু মিশর, মরক্কো, সিশেলস এবং গায়ানা। টিকা পরিকল্পনা নিয়ে মহাদেশটির বাকি দেশগুলোর অবস্থা তথৈবচ। মধ্য এশিয়া বা মধ্য আমেরিকা অঞ্চলেও দেখা যাচ্ছে না গণটিকাদানের প্রচেষ্টা। যেসব দেশ শুরু করেছে, তা চলছে অস্বস্তিকর ধীরগতিতে।
এই ধীরগতি নিয়ে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সামনে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরার ঝুঁকি। মুক্তবাজারের যুগে বিশ্ব অর্থনীতি একসুতোয় গাঁথা। তাই সম্ভাবনাময় বাজারে মন্দা; যেসব ধনী দেশ টিকাদানে সফল- তাদের অর্থনৈতিক উত্তরণের পা টেনে ধরবে। অর্থাৎ, মন্দ- চাহিদার কারণে সফল দেশের পণ্য ও সেবা রপ্তানির সুযোগ কমবে টিকাদানে সফল নয় এমন দেশের বাজারে। বহুলাংশে হ্রাস পাবে উন্নত বিশ্ব থেকে ভারি ও মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি।কিন্তু, তার চাইতেও বড় বিপর্যয় হতে পারে, জীবাণুর নতুনতর অভিযোজনের ঝুঁকি, যার ফলে একদিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, অন্যদিকে, বিশ্ব অনুভব করবে সমান মাত্রার আরেক জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ।
'জীবাণুর অভিযোজন চলমান থাকায় পুরো বিশ্বের সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনার আগপর্যন্ত কোনো দেশ আর নিরাপদ নয়,' বলে মন্তব্য করেন সিঙ্গাপুরের মেব্যাঙ্ক কিম এং রিসার্চের প্রধান অর্থনীতিবিদ চুয়া হাক বিন।
ব্যর্থতার পরিণাম:
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের অর্থায়নে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানানো হয়, অসম টিকাদানে বিশ্ব অর্থনীতি ৯ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতির শিকার হবে।
র্যান্ড কর্পোরেশনের করা একই রকম আরেক গবেষণায়, এরফলে প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যেই, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের ৪ শতাংশের অর্ধেক হতে পারে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি। টিকা বিতরণ সকল দেশে সমানতালে না চললেই এমন অবস্থা দেখা দেওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কারমেন রেইনহার্ট।
এধরনের পূর্বাভাস ধনী দেশগুলোর প্রতি তাদের মজুদকৃত ভ্যাকসিনের ডোজ দরিদ্র দেশে সাহায্য হিসেবে দেওয়ার তীব্র চাপ সৃষ্টি করছে। ধনী দেশের জনগণ এমন মহৎ উদ্যোগে সমর্থন দেবেন না- তা বলাই বাহুল্য। বরং, তাদের অধিকাংশই আরও টিকা কিনে রাখার জন্য নিজ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
মহামারি শুরুর বছরে পিপিই নিয়ে রক্ষণশীল আচরণের পর, এবার ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়েও একই রকম মনোভাব দেখাচ্ছে ইউরোপীয় দেশসমূহ। এছাড়া, সকলের জন্য টিকার সুযোগ নিশ্চিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগেও পর্যাপ্ত অর্থায়ন করেনি বৃহৎ অর্থনীতিগুলো।
জীবাণু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সবার আগে অর্থনৈতিক উত্তরণে ফেরে চীন। কিন্তু, টিকাদানে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে দেশটি পশ্চিমাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে, বলে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে হংকং ভিত্তিক আর্থিক গবেষণা সংস্থা- গ্যাভেকাল ড্রাগোনোমিক্স।
কোভ্যাক্সের সাহায্যে অচিরেই টিকা ডোজের প্রথম চালান পাবে উন্নয়নশীল বেশকিছু দেশ। কোভ্যাক্স ৯ কোটি ৭২ লাখ ডোজ পাঠাবে ভারতে, তারপর পাকিস্তান পাবে ১ কোটি ৭২ লাখ আর তৃতীয় বৃহৎ গ্রহীতা হবে নাইজেরিয়া ১ কোটি ৬০ লাখ ডোজ পেয়ে।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স কী বলছে......
''আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির উত্তরণ বিষয়ক পূর্বাভাসকে তীব্র ঝুঁকিতে ফেলেছে টিকাদান ও সরবরাহের সমস্যা। নিয়ন্ত্রণহীন মহামারির অর্থ হলো; দীর্ঘমেয়াদে উদীয়মান বাজার দুর্বল অবস্থানে থাকবে। ভাইরাসের দাপটে এসব দেশের অন্যান্য সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে; মহামারির প্রথম পর্যায়ের অচলাবস্থা ফিরে আসতে পারে''
-- ব্লুমবার্গ অর্থনীতিবিদ জিয়াদ দাউদ ও স্কট জনসন
র্যান্ড কর্পের হিসাব অনুযায়ী, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের ফলে উন্নত দেশগুলোকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। আখেরে তাদের বার্ষিক রপ্তানি ক্ষতি হতে পারে ১১৯ বিলিয়ন ডলার। তবে মাত্র ২৫ বিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক টিকা সরবরাহে উদ্যোগী হলে, তারা এই ক্ষতি এড়াতে পারবে। ধনী দেশের পক্ষ থেকে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের গবেষণাটি করে কোক ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড। গবেষকদের মতে, পৃথিবীজুড়ে মহামারির অশুভ প্রভাব চলতে থাকলে; উন্নত অর্থনীতিগুলোর ক্ষতি হবে সামষ্টিক বৈশ্বিক ক্ষতির ৪৯ শতাংশ। নিজেদের সকল নাগরিককে টিকা দিতে পারলেও, তারা এই বিপর্যয়কে এড়াতে পারবে না।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ