ব্রিটিশ-বাঙালি লেখিকার বাংলা শেখার পুনর্যাত্রা
ক্রাইম থ্রিলার সাহিত্যিক কিয়া আবদুল্লাহ লন্ডনে যে স্কুলে পড়তেন, সেখানকার ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই ছিল বাঙালি। কিন্তু, নব্বইয়ের দশকে কিয়ার সহপাঠীরা ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি ভালোবাসত। বাংলা বলাটা তাদের কাছে কেমন 'ক্লিশে' মনে হত। অন্যদিকে, ইংরেজি বলার মধ্যে ছিল এক ধরনের উন্নাসিকতা। তবে সহপাঠীদের থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন কিয়া।
বাঙালি অভিবাসী পরিবারে বেড়ে ওঠা কিয়া ছোট থেকেই বাংলাকে আপন করে নিয়েছিলেন। বিশেষত, মায়ের সাথে কিয়াকে সবসময় সিলেটি বাংলাতে কথা বলতে হতো। কিয়ার কাছে মায়ের সূক্ষ্ম আবেগগুলো কেবল বাংলাতেই ধরা দিত।
কিন্তু, সময়ের সাথে কিয়া বাংলার সেই সাবলীলতা হারাতে থাকেন। বিশেষ্ বাড়ি ছাড়ার পর বাংলায় আর কথা বলা হয়ে উঠত না। ২০০৭ সালে কিয়ার বাবা মারা যান। এরপর থেকে একমাত্র মা-ই আছেন, যার সাথে বাংলায় কথা বলেন। কিয়া বেশ বুঝতে পারছিলেন, দিন দিন তার বাংলার চর্চাটা কেমন হারিয়ে যেতে বসেছে।
তারপর এলো ২০২০ সাল৷ কোভিড-১৯ এর কারণে সব বাড়িঘর আইসোলেশনে। মায়ের সাথে কিয়ার দূরত্ব যেন যোজন-যোজন বেড়ে গেল। ফোন হয়ে উঠল যোগাযোগের শেষ ভরসা। যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল একমাত্র বাংলা ভাষা। কিন্তু, কিয়া সেটাও ভুলতে বসেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত, মায়ের একাকীত্ব দেখে তিনি পুনরায় মাতৃভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাষা শেখার অ্যাপ থেকে শুরু করে, রেডিও, পডকাস্ট, স্ব-শিক্ষার বই সব পড়া শুরু হল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল কিয়ার শব্দভান্ডার।
এরপর নিয়মিতভাবে তিনি মাকে ফোন দেওয়া শুরু করলেন। কথার মাঝে এবার সব জড়তা কেটে গেল। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি হিসেবে কিয়া যা করে দেখালেন, তা সবার পক্ষে হয়ে উঠে না। কিয়ার ঠোঁটে ছেলেবেলায় বাংলার সেই সাবলীলতা আবার ফিরল।
কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করেন কিয়া আবদুল্লাহ। কিন্তু লেখক হওয়ার স্বপ্ন তাকে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে সাহিত্যের জগতে টেনে আনে। এখন পর্যন্ত কিয়ার চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে 'টেক ইট ব্যাক' উপন্যাসটি ২০১৯ সালে দ্য গার্ডিয়ান এবং টেলিগ্রাফের সেরা থ্রিলারের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে এক সাক্ষাৎকারে কিয়া আবদুল্লাহ তার লেখালেখি, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস): লন্ডনে আট ভাইবোনের সাথে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
কিয়া আবদুল্লাহ: পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে আট ভাইবোনের পরিবারে আমার শৈশব কাটে। আমাদের বাড়িতে সবসময় নাটকীয়তা আর ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকত। আমি বলব, লেখকের জন্য অবশ্যই সেটা অভিজ্ঞতা লাভের এক চমৎকার জায়গা ছিল।
এটা বেশ অদ্ভূত। কারণ টাওয়ার হ্যামলেটস একদিকে আমাকে অভিজ্ঞতা সঞ্চারে সাহায্য করলেও অন্যদিকে আমার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হ্যামলেটস যুক্তরাজ্যের সবথেকে বাজে জায়গা, যেখানে শিশুদের দারিদ্র্যতার মুখোমুখি হতে হয়। আমার মনে হয়, এটা বললে ঠিক হবে যে, শিল্পচর্চার পথে আয়ের স্বল্পতা অন্যতম এক প্রতিবন্ধক।
তবে, এরকম পরিবেশে বড় হওয়ার বিশেষ এক দিক আছে। সরু গলির কঙ্কর আর গুঞ্জনের মাঝে জীবনের চমৎকার সব উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
টিবিএস: আপনার বায়োতে লেখা আছে- "২০০৭ সালে কিয়া তার প্রযুক্তিখাতের চাকরি ছেড়ে দেন, শুধুমাত্র লেখক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য, যেটা তিনি সবসময় চেয়েছেন। যার জন্য তার আয় ৫০ শতাংশ কমে যায়।" আপনি কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতক থেকে লেখক হলেন। এই যাত্রা কেমন ছিল?
কিয়া: আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে বললে, ভালো ছিল না। কেউই ৫০ শতাংশ উপার্জন কমার বিষয়টি উপভোগ করে না! তবে আসল কাজের কথা বললে, মনে হয়েছিল যেন ঘরে ফিরলাম। মানে আমার যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, শেষপর্যন্ত সেখানে পৌঁছোতে পেরেছি।
আমি এশিয়ান উইমেন ম্যাগাজিনে সম্পাদনার কাজ করেছি। সেখানে কাজ করাটা ভীষণ উপভোগ করেছি। প্রকাশনার কাজের সেই হইচই, চ্যালেঞ্জ, সবার এক লক্ষ্য – এই বিষয়গুলো আসলে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
তবে অবশ্যই একটা সময় ছিল যখন আমাকে মানিয়ে নিতে হয়েছে। আমি জানতাম না যে, ডিপিএস বা টিয়ারশিট কী, কিংবা ফ্ল্যাটপ্যান কী জিনিস। আমাকে চাকরির জন্য মৌলিক এসব বিষয় শিখতে হয়েছে। তবে এখানে লজ্জা পাওয়ার মতো কিছুই নেই। আমি সম্প্রতি এক লেখায় পড়েছি যে, তুমি যদি ভয় পাও যে তিন বছর একটা কোর্স করলে তোমার বয়স তিরিশে গিয়ে পড়বে এবং সেটা শেখা থেকে বিরত থাকো, তবে তিন বছর পর ঠিকই তোমার বয়স তিরিশ হলেও, সেই শেখাটা আর সম্পন্ন হবে না। এজন্য, এগিয়ে যাও আর ঝাঁপিয়ে পড়ো! আমিও ক্যারিয়ারে এই বিষয়টি অনুসরণ করি।
টিবিএস: আপনার আইকিউ ১৫০। মেনসা ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন সদস্য হিসেবে অন্যান্য উচ্চ আইকিউধারীদের সাথে সময় কাটাতে কেমন লেগেছে?
কিয়া: সত্যি বলতে, আমি কোনো মিটিং-এ যাইনি এবং অন্য সদস্যদের সাথেও দেখা করিনি। আমি কৌতূহল থেকে নিজের মূল্যায়ন করিয়েছিলাম। সেখানকার সদস্য হতে পারাটাও দারুণ ছিল। কিন্তু, আমি সেখানকার সদস্য হওয়ার কোনো সুবিধা নেইনি। আমি সেখানকার ম্যাগাজিন পেতাম এবং পৃষ্ঠা উলটে দেখতাম। এতটুকুই ছিল আমার কাজ। শেষপর্যন্ত কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে, সেখান থেকে সরে আসি।
টিবিএস: মহামারি চলাকালীন আপনি মায়ের সাথে কথা বলার জন্য পুনরায় সিলেটি ভাষা শিখেন। আপনার মা যখন আবার আপনাকে সাবলীল বাংলায় কথা বলতে শুনল, তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
কিয়া: সেটা আসলে ধীরে ধীরে হয়েছে। বিষয়টা এমন ছিল না যে, এর আগে আমি বাংলা বলতে জানতাম না, তারপর হঠাৎ একদিন বলে বসলাম। ধীরে ধীরে আমার অন্য শব্দ ধার করে কথা বলার অভ্যাস কমতে থাকল। সেই সাথে কথা বলার সময় আর বিষয়বস্তুও বেড়ে গেল। এটা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ছিল, কেননা ওই সময়টা মাকে একা কাটাতে হত।
সবকিছু স্বাভাবিক হলে আমি আরেকটা জিনিস করতে চাই। মায়ের বাসায় গিয়ে বোনরাসহ সবাই মিলে বাংলায় গল্প করতে চাই। আমরা সাধারণত ইংরেজিতে কথা বলে ফেলি, আর মাকে দেখি শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। সন্তানদের মাঝে থাকার পরেও তাকে একা থাকতে হতো। এখন থেকে আমাদের গল্পে তাকেও যুক্ত করার বিষয়টি খেয়াল রাখব।
টিবিএস: ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আপনার চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। 'টেক ইট ব্যাক' নামের উপন্যাসটি ব্রিটিশ গণমাধ্যমে অন্যতম সেরা ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। থ্রিলার ফিকশন লেখার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন? আপনি কি অন্য জনরার লেখাও লিখতে চান?
কিয়া: আমার কাছে মনে হয়, সমাজের বর্ণনা দেওয়ার জন্য ক্রাইম ফিকশন সবথেকে উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে। প্রথাগত সাহিত্য ভাবনায় কল্পকাহিনীকে ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু আমার কাছে সমাজের ঘুণে ধরা প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরতে ফিকশনকেই শক্তিশালী পথ বলে মনে হয়। আবির মূখার্জির উইনডাম সিরিজের সাম্রাজ্য হোক কিংবা আমার 'টেক ইট ব্যাক' উপন্যাসের বর্ণভেদ- ক্রাইম ফিকশন পাঠকপ্রিয়, সহজপ্রাপ্য থ্রিলারের ছদ্মবেশে বেশ জটিল বিষয়কে তুলে আনতে পারে। আমি যতদিন পারি এই জনরায় কাজ করে যাব।
টিবিএস: আপনি তো ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসেন। বাংলাদেশের কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে কী?
কিয়া: আমার পরিবার সুনামগঞ্জে থাকত। আমি সেখানে দুবার গিয়েছি, কিন্তু অনেক আগে। আমি আবার সেখানে যেতে চাই। সেইসাথে পুরো দেশটাকেও নতুন করে আবিষ্কার চাই। আমি সম্প্রতি গোবিন্দ মন্দিরের ছবি দেখেছি যেটা খুব সুন্দর ছিল। এছাড়া লালবাগের কেল্লা এবং অবশ্যই সমুদ্রের তীরে যেতে চাই।
এটা সত্যিই খুব লজ্জার। কেননা আমি আমার বাংলাদেশি পরিচয় নিয়ে সবসময় গর্ব করে আসছি। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ব্রিটেনে। আমি নিজেকে প্রকাশও করি ইংরেজি ভাষাতেই। আর তাই বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশটাও সবসময় পেছনে পরে যায়।
সম্প্রতি পুনরায় মাতৃভাষা শেখা নিয়ে আমার প্রবন্ধ প্রকাশের পর দ্বিতীয় প্রজন্মের বহু বাংলাদেশি আমার কাছে একই রকম অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছে। একই সাথে দুটো সংস্কৃতি থাকাটা সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু, অতীতে আমি এটা নিয়ে তেমন ভাবিনি বলে হতাশও বোধ করি।
টিবিএস: আপনি কেন লিখতে ভালোবাসেন?- এই ভীষণ পুরোনো আর ক্লিশে প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিবেন?
টিয়া: লিখতে ভালোবাসি কারণ, লেখালেখি আমাকে ক্ষমতার যোগান দেয়। পিতৃতন্ত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত এই পৃথিবীতে নারী, বিশেষত অশ্বেতাঙ্গ নারী হলে আপনার হাতে খুব সীমিত ক্ষমতা থাকে। আপনি যদি একটা বই কিংবা প্রবন্ধ লিখেন, তাহলে বহু মানুষের কাছে আপনার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হবে। মানুষ আপনাকে শুনতে পাচ্ছে, এই ক্ষমতাটা লেখালেখি থেকেই আসে।
টিবিএস: বাংলাদেশের সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কেমন বোধ করেন? এখানকার আত্মীয়দের কাছে আসা হয়?
কিয়া: আমি আগেও বলেছি, আমি আমার বাংলাদেশি হেরিটেজটা বেশ উপভোগ করি। তবে আমি সেখানে মাত্র দু'বার গেছি। একবার চার বছর বয়সে, আরেকবার তেরো বছর থাকতে। সেসব আজ থেকে বহু বহু বছর আগের কথা। আমি আবার বাংলাদেশে যেয়ে পুরো দেশ ঘুরে দেখতে চাই।
এছাড়া, আমি আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানতে চাই। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন সাম্রাজ্য, দেশ বিভাগ, উপনিবেশবাদ এসব স্কুলে শেখানো হতো না। আর তাই এ সম্পর্কে আমার ধারণা অপেক্ষাকৃত কম। সেটা নিয়ে আমার দুঃখও হয়।
আলাদা করে বললে, আমি বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে আমার মায়ের যাত্রা সম্পর্কেও খুব কম জানি। মাঝেমধ্যে সে আমাদের টুকটাক বলে। তবে আমার মা অতীতকে অতীতে রাখতেই পছন্দ করেন।
আমি একান্তে তার সাথে বসে দেশ ছেড়ে এখানে আসার অভিজ্ঞতাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই। বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক বেশ গভীর। সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা তুললে সে সত্যি ভীষণ খুশি হয়।
টিবিএস: আপনার প্রিয় লেখক কারা? বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কারও লেখা কি ভালো লাগে?
কিয়া: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কথা বললে সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে তাহমিমা আনামের 'গোল্ডেন এজ' এবং 'দ্য গুড মুসলিম'-এর কথা বলব। শাহনাজ আহসানের বই 'হাশিম এন্ড ফ্যামিলি' নিয়েও আমি বেশ উৎসুক। যুক্তরাজ্যে বইটি সমালোচকদের কাছে দারুণ আলোচিত হয়েছে।
বিশদভাবে বললে, ডোনা টারট এবং জেফরি ইউজিনিডসকে আমার অসাধারণ লেখক মনে হয়। তবে গল্প বলার প্রসঙ্গ আসলে কম লেখকই স্টিফেন কিং এবং জোডি পিকোর সমকক্ষে আসতে পারবে। তাদের লেখার সংখ্যা অনেক হলেও মানের সাথে কখনো আপোষ করেননি। এটা অবশ্যই বিশাল এক অর্জন।