রেজিস্ট্রেশন বিভাগকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার প্রস্তাব ছয়বছর ধরে ঝুলছে
ভূমি নিবন্ধনে হয়রানী কমাতে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'নিবন্ধন অধিদপ্তর'কে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার প্রস্তাব ছয় বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
দেশের জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলো নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীনে। যেখনে ভূমি হস্তান্তরের পর নিবন্ধন করা হয়। নিবন্ধনের জন্য ভূমি খারিজ, খাজনা আদায়, পরচা, খতিয়ান সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় এসি ল্যান্ড ও সেটেলমেন্ট অফিসে। আর এই দুই অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব অফিসের সাথে রেজিস্ট্রেশন অফিসের কোনো কানেকশন না থাকায় দলিল নিবন্ধনের জন্য ভূমি খারিজ, খাজনা আদায়, পরচা ও খতিয়ান যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের।
ফলে একদিকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে দলিল নিবন্ধন করলে তা সহজে ধরতে পারেন না সাব-রেজিস্ট্রাররা। আবার এসব কাগজপত্র যাচাই করতে চাইলেও অনেক সময় ব্যয় হয়। ফলে ভূমি হ্স্তান্তরের জন্য উভয়পক্ষকে হয়রানির শিকার হতে হয়।
জানা যায়, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন ভূমি মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ। ওই চিঠিতে বলা হয়, একসময়ে আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয় একত্রে ছিল। পরে পৃথক হওয়ার সময় ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে যায়। ভূমি ব্যবস্থাপনা কাজে গতি আনতে এই তিনটি শাখাকে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা প্রয়োজন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত তা কাজে আসেনি।
ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মকবুল হোসেন এমপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় আমরাও চাই রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসুক। কারণ, জনগণের হয়রানী কমাতে ও নিবন্ধন কাজে গতি আনতে এই তিনটি শাখাকে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার বিকল্প নেই। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই রেজিস্ট্রেশন বিভাগ তাদের ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।'
তিনি বলেন, একটু জটিলতার কারণে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সময় লাগছে।
রেজিস্ট্রেশন বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টরা টিবিএসকে জানিয়েছেন, নিবন্ধন বিভাগ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় আসে। আইন মন্ত্রণালয় এই বড় পরিমান রাজস্ব আদায়ের কৃতিত্ব হাতে রাখার জন্য নিবন্ধন বিভাগ হাত ছাড়া করতে চাচ্ছে না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পর নিবন্ধন বিভাগকে যুগোপোযোগী করার জন্য সকল ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। নিবন্ধন পরিদপ্তরকে নিবন্ধন অধিদপ্তরে পরিণত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এছাড়াও এই বিভাগকে আধুনিকায়নের কাজ করছে।
তিনি বলেন, সরকার চাইলে নিবন্ধন বিভাগকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে পারবে। তবে এই বিভাগের চলমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখছে আইন মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের আগে ভূমি মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির একাধিক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়কে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সংসদীয় কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া তৈরি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে খসড়াটি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির একজন সদস্য জানান, ওই বছরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকও করেন। ওই বৈঠকের পর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আইনমন্ত্রীকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য দলিল দাতা ও গ্রহীতাকে প্রায় ২২ ধরনের তথ্য ও বিগত ২৫ বছরের জমির মালিকানার বিবরণ উল্লেখ করে দলিল তৈরি করতে হয়। মূল দলিলের জন্য এক কপি ও ডুপ্লিকেট কপির জন্য আরো এক কপি দলিল সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে হয়। জমি নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর দাখিলকৃত ডুপ্লিকেট কপি দলিল গ্রহীতাকে প্রদান করা হয় ও অন্য মূল কপিটি জেলা রেজিস্ট্রারের অফিসে রক্ষিত বালাম বইয়ে হাতে লিপিবদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয়। তবে হাতে লিপিবদ্ধ করা অনেক সময়সাপেক্ষ ও হাতের লেখাও অস্পষ্ট হয়। নামজারির ক্ষেত্রে দলিলের সার্টিফায়েড কপি বাধ্যতামূলক হওয়ায় এবং সার্টিফায়েড কপি অস্পষ্ট ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্যগত ভুল থাকায় নামজারি সম্পাদনে জটিলতা দেখা দেয়।
সারসংক্ষেপে বলা হয়, দলিল সম্পাদনের পর দাতা, গ্রহীতা, দলিলের ধরন, কেবল মালিকানা হস্তান্তরের সূত্র, হস্তান্তরের তারিখ, হস্তান্তরিত দলিলের মূল্য, তফসিলের অপূর্ণাঙ্গ বিবরণসহ সাব-রেজিস্ট্রারের নামবিহীন, সিলবিহীন ও অস্পষ্ট স্বাক্ষরযুক্ত এলটি (ল্যান্ড ট্রান্সফার) নোটিসের কপি রেকর্ড হালনাগাদকরণের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবরে প্রেরণ করা হয়। এছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বিভিন্ন তারিখে সম্পাদিত দলিলের অনেক এলটি নোটিস একত্রে প্রেরণ করা হয়। ফলে অপূর্ণাঙ্গ ও অস্পষ্ট তথ্য সংবলিত এলটি নোটিসের ভিত্তিতে নামজারি সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।
সাধারণত রেজিস্টার্ড হস্তান্তর দলিল, জরিপ, বিজ্ঞ আদালতের রায় এবং উত্তরাধিকার সূত্রে ভূমির মালিকানা পরিবর্তন হয়। তার মধ্যে রেজিস্টার্ড হস্তান্তর দলিলের মাধ্যমেই সিংহভাগ মালিকানা পরিবর্তন হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জমি হস্তান্তর দলিল রেজিস্ট্রেশনের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে একজন দলিল দাতা বা গ্রহীতাকে তার মালিকানার ধারাবাহিকতা বা রেকর্ডপত্রের সঠিকতা বা সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সার্কেল অফিস বা উপজেলা ভূমি অফিস বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দ্বারস্থ হতে হয়। দলিল রেজিস্ট্রেশনের পর পরই মালিকানা পরিবর্তনের বিষয়টি নামজারির মাধ্যমে হালনাগাদ করা হয়। জমি নিবন্ধনের আগের ও পরের প্রায় সব কার্যক্রম সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়সংশ্লিষ্ট। মাঝখানে আইন ও বিচার বিভাগের আওতাধীন সাব-রেজিস্ট্রারের দলিল সম্পাদন ব্যতীত আর কোনো কাজ নেই।
সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন ভূমি হস্তান্তর দলিল নিবন্ধন করা সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার সঠিকতা নিশ্চিত করে থাকলেও সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক দাতার মালিকানা যাচাইয়ের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩ (গ) ধারা মোতাবেক জমি দাতা বা বিক্রেতার নামে খতিয়ান ব্যতীত স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর করা যায় না।
তাই দলিল রেজিস্ট্রেশনের কাজ ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলে সেবা গ্রহীতাদের দুর্ভোগ অনেক কমে আসবে বলে সারসংক্ষেপে তুলে ধরা হয়।