চট্টগ্রাম ওয়াসা: ভুতুড়ে ওভারটাইমের উপাখ্যান
চট্টগ্রাম ওয়াসার বদ্দারহাটের খাজা রোডে ৪ নং পাম্পে কাজ করেন ওয়াহিদুর রহমান, আখতার হামিদ খান এবং গিয়াস উদ্দিন মুর্শেদ। এ বছরের জুলাইতে নিয়মিত ৫২৮ কর্মঘণ্টার পাশাপাশি মোট ৩৭৬ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিল জমা দিয়েছেন তারা তিনজন। তার মানে দাঁড়ায়, শুধু এক মাসেই তারা মোট ৯০৪ ঘণ্টা কাজ করেছেন, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা কাজ করেছেন ২৯ ঘণ্টা!
চট্টগ্রাম ওয়াসার ইলেকট্রিশিয়ান আলী আক্কাস। গত জুলাই মাসে তার কর্মস্থলে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার পরেও ওভারটাইম হিসেবে আরও ২০০ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন তিনি।
গত বছরের একই মাসে আক্কাসের মাসিক বেতন ছিল ১৯ হাজার ৮১০ টাকা। অথচ সেই মাসে শুধুমাত্র ওভারটাইম করেই আক্কাস আয় করেছিলেন ৩৮ হজার ২৫১ টাকা।
২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মীদের বেতনের তালিকা এবং অন্যান্য নথি ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে। এমন করেকটি নথি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে রয়েছে।
নথিগুলো ঘেঁটে ওয়াসা কর্মীদের এমন প্রশ্নবিদ্ধ ওভারটাইমের পাশাপাশি অন্যান্য অনিয়ম সম্পর্কে জানা যায়।
নথির তথ্য অনুযায়ী, বহাদ্দারহাটের চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনের ইলেকট্রিশিয়ান আক্কাস ২০১৭ সালের পর থেকে প্রতি মাসেই প্রায় ২০০ ঘণ্টা করে ওভারটাইমের টাকা তুলে আসছে যা তার বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। সেই অনুযায়ী, গত দুইবছরে প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা করে ওই স্টেশনে কাজ করতে হচ্ছে আক্কাস আলীকে ।
আক্কাসের মতোই তার দুই সহকর্মী মাহবুবুল আলম মিয়া এবং মো. আজমলও একইভাবে অস্বাভাবিক ওভারটাইমের টাকা পেয়ে আসছেন। পাম্প অপারেটর হিসেবে তাদের মাসিক বেতন ১৯ হাজার ৮১০ টাকা হলেও প্রতিমাসে তারা প্রত্যেকেই ওভারটাইম হিসেবে ২৭ হাজার ৪৭৪ টাকা অতিরিক্ত আয় করেন।
ওই স্টেশনের আরেক কর্মচারী মোটর মেকানিক নিজাম উদ্দিন। প্রতিমাসে ওভারটাইম হিসেবে তার বাড়াতি আয় ২৮ হাজার ২৫১ টাকা।
ওই নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ওয়াসার এই বুস্টার স্টেশনটিতে ২০ জন কর্মচারীর মধ্যে ১৭ জনই ওভারটাইম হিসেবে নিজেদের মূল বেতনের চেয়ে বেশী টাকা তোলেন।
এবছরের জুলাই মাসের বেতন নথি থেকে দেখা গেল, ২০ জন কর্মচারীর বেতন বাবদ ওয়াসা দিয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৬০০ টাকা। সেখানে ওভারটাইম দিয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ১৬৮ টাকা! গত বছরের জুলাইতেও যেখানে বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫০ টাকা, সেখানে ওভারটাইম দেয়া হয়েছিল ৩ লাখ ২৮ হাজার ২৮৬ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাইতেও বেতন বাবদ ওয়াসার খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৮০ টাকা। আর ওভারটাইম বাবদ দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টাকা।
আলী আক্কাসকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, কর্মচারী সংকট থাকায় অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়েছে আমাকে। অনেক লম্বা সময় ধরে ওভারটাইম করেছি আমি।
তবে আক্কাস আলীর সুপারভাইজার বুস্টার স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সরফরাজ আক্তার বলেন, “আক্কাস ২০০ ঘণ্টা ওভারটাইম কিভাবে করলো তা তো বুঝতেই পারছি না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, “মাসে সর্বোচ্চ ১৫২ ঘণ্টা ওভারটাইম করতে পারবে কোন কর্মচারী।
চট্টগ্রাম ওয়াসার অন্যান্য স্টেশনে গিয়েও দেখা গেল চিত্র। অস্বাভাবিক সব বিল ও খাতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করছে কর্তৃপক্ষ।
এক তদন্তে প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ও মোডিউল ১,২,৩ এর পাম্প অপারেটর, ইলেক্ট্রিশিয়ান, সহকারী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং ল্যাবরেটরি সহকারীসহ মোট ৪৯ স্থায়ী কর্মচারীর সবাই ওভারটাইমের নামে বড় অঙ্কের টাকা তুলেছেন।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার এর ৩৪ কর্মচারী বেতন বাবদ পেয়েছেন ৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৪০ টাকা এবং ওভারটাইম হিসেবে পেয়েছেন ৪ লাখ ৮০ হাজার ২৬১ টাকা। আর এ বছরের জুলাইতে তাদের ওভারটাইম বাবদ ওয়াসা খরচ করেছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭৯ টাকা যেখানে তাদের মূল বেতনের জন্য খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ টাকা।
নথির তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই চট্টগ্রাম ওয়াসার ২২৯ জন পাম্প অপারেটর এবং ইলেক্ট্রিশিয়ান ওভারটাইম হিসেবে পেয়েছেন ৩৪ লাখ টাকা।
প্রতি বছর কর্মচারীদের ওভারটাইম বাবদ ৫.১৯ কোটি টাকা এবং বেতন বাবদ ৪.১৬ কোটি টাকা ব্যয় করে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
বোঝাই যাচ্ছে, কাগজে কলমে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা বা ওভারটাইম দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে ওয়াসার স্টাফ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ওভারটাইম অনুমোদন এবং দেয়ার দায়িত্বে কাজ করেন সুপারিনটেন্ডেন্ট প্রকৌশলী মাকসুদুল আলম। তিনি বলেন, “এজন্য আমি দায়ী নই, কারণ কাজের চুক্তিপত্র এবং ওভারটাইমের বিল তৈরি করেন নির্বাহী প্রকৌশলীরা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফয়জুল্লাহ বলেন, “পাম্পগুলো চালু রাখার জন্য মাঝে মাঝে ওভারটাইম করাতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ওভারটাইমের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন থাকার চেষ্টা করি। কর্মচারীদের ওভারটাইম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বন্ধ পাম্প চালাতেও ওভারটাইম!
চট্টগ্রাম ওয়াসার দেয়া তথ্য মতে, বদ্দারহাট, চন্দগাঁও, বাকোলিয়া আর খাতুনগঞ্জ নিয়ে মডিউল ৩ গঠিত হয়েছে। এই এলাকার পানি সরবরাহের জন্য তিনটি পাম্প বর্তমানে চালু আছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে বন্ধ আছে বাকি ৩৬ টি পাম্প।
অথচ বন্ধ থাকা এই পাম্প স্টেশনগুলোতেও কাজ করে যাচ্ছেন কর্মচারীরা।
শুধু তাই নয়, নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি ওভারটাইমও পেয়ে আসছেন তারা।
কালুরঘাট বুস্টারের একটি বন্ধ পানির পাম্পে অপারেটর হিসেবে কাজ করেন মুজিবুল হক। তিনি বলেন, পাম্প বন্ধ থাকলেও ওয়াসার পরিচালকের নির্দেশে এখানে থাকতে হয় আমাদের। চুক্তি অনুযায়ী তিনজন পাম্প অপারেটর পালা করে এখানে দায়িত্ব পালন করেন। আর স্থায়ী যারা তারা ওভারটাইম পায়।
বদ্দারহাটের আরেকজন পাম্প অপারেটর আবদুল্লাহ আল হোসাইনও একই কথা জানালেন।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফয়জুল্লাহ বলেন, মধুনাঘাট পানি শোধনাগারের পাম্পে কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে জরুরি অবস্থায় অন্য পাম্পগুলো সচল রাখা যায় সেজন্য কর্মচারী রাখা হয়েছে।
যদিও গত ১ বছরে এমন কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি।
নথি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ওয়াসার মডিউল ৩ এলাকায় কাজ করেন ৪৯ স্থায়ী কর্মচারী। হিসেব করে দেখা গেছে প্রতি মাসে ৫ হাজার ৮২০ ঘণ্টা কাজ করেন তারা, যার বিনিময় তারা প্রায় ৮.৩৮ লাখ টাকা পান। যেখানে তাদের মূল বেতন ৭.৩৭ লাখ টাকা।
এর আগে, চট্টগ্রাম ওয়াসার ৯৪ টি পাম্প (গভীর নলকূপ), বুস্টার স্টেশন ও শোধনাগারগুলো চালু রাখতে কাজ করছিলেন ২২৯ জন স্থায়ী কর্মচারী। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী এখানকার কর্মচারীদের ওভারটাইমের জন্য প্রতি মাসে গড়ে ৩০.৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
২০১৬ সালে অস্বাভাবিক ওভারটাইমের পরিমাণ কমাতে ১৫৫ জনকে মাসিক চুক্তিতে কাজে নেয় ওয়াসা। এতে প্রতি মাসে খরচ হয় ১৮.৬০ লাখ টাকা।
৫৩ টি পানির পাম্প ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। কিন্তু তবুও ওভারটাইমের বরাদ্দ থামে নি।
২০১৬-১৭ সালে প্রতি মাসে ওভারটাইম বাবদ খরচ হয়েছে ৩০.৭৫ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩৪.৬৭ লাখ টাকা।