জনপ্রতি রেমিট্যান্স আয়ে নিচের সারিতে বাংলাদেশ
২০১৬ সালে ২৭ বছর বয়সী মো. রনি ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে কাতারে পাড়ি জমান। সেখানকার একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে মাসিক ১৮ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হন। কাতার যেতে তার খরচ পড়েছিল আড়াই লাখ টাকা, কোনো প্রশিক্ষণও ছিলনা তার।
তারপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, বর্তমানে তিনি দোহায় মাসিক ২৪ হাজার টাকা বেতনে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
৫০ বছর বয়সী আরেকজন প্রবাসী, আনোয়ার হোসেন সৌদি আরবের আল কাশিমে গাড়ি চালিয়ে মাসিক ৪৫ হাজার টাকার মতো উপার্জন করেন। অধিক দক্ষতা অধিক উপার্জনের সুযোগ করে দেয়- এই দুইজন প্রবাসীর বেতনের পার্থক্য দেখলেই তা বোঝা যায়।
বাংলাদেশের প্রায় ৪৭ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিকেরই দক্ষতার অভাব আছে। দক্ষ জনবলের চেয়ে তাদের উপার্জনও কম। ফলে বাংলাদেশের জনপ্রতি রেমিট্যান্সও কম।
সবচেয়ে বেশি অভিবাসী পাঠানো দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ, তবে রেমিট্যান্স আহরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বেশি শ্রমিক পাঠিয়েও সে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে না। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের মতো বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বৈশ্বিক বাজারে দক্ষ জনবল পাঠানোর কারণেই বেশি আয় করছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএমও), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও দেশগুলোর সরকারি হিসাবমতে দেখা যায়, বাংলাদেশি অভিবাসীদের মাত্র ৩৬ শতাংশ দক্ষ, শ্রীলঙ্কার ৪৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ৪৩ শতাংশ ও ফিলিপাইনের ৪৫ শতাংশ।
বিভিন্ন দেশে নেপালের অভিবাসীদের ১২.৫৮ শতাংশ দক্ষ, বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে দেশটি। আইওএমে'র তথ্যানুযায়ী, একজন প্রবাসী বাংলাদেশি গড়ে মাসপ্রতি ২০৩.৩৩ ডলার (১৭ হাজার ২৩৬ টাকা) রেমিট্যান্স পাঠান। ফিলিপাইনের একজন শ্রমিক পাঠান ৫৬৪.১ ডলার, যা বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
পাকিস্তানের একজন প্রবাসীর গড়ে মাসিক আয় ২৭৫.৭৪ ডলার, ভারতের প্রবাসীদের গড় মাসিক আয় ৩৯৫.৭১ ডলার ও চীনের ৫৩২.৭১ ডলার।
বিশেষজ্ঞরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকরা অদক্ষ হওয়ার কারণেই রেমিট্যান্স আহরণের দিক দিয়ে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, মিশর ও চীনের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর সংখ্যা বাড়লে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর অবস্থানে যেতে পারবে বলে জানান তারা।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ভারত, চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, মিশর, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ দশটি দেশ।
এব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান এইচ মানসুর বলেন, "স্বাস্থ্যসেবা, সেবা খাত, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন, প্লাম্বিং অ্যান্ড পাইপ ফিটিংস, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং, গ্রাফিকস ডিজাইন ও বৈদ্যুতিক কাজ এসব ক্ষেত্রের দক্ষ শ্রমিকদের বিদেশের পাঠানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে,"
"আমরা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহপরিচারিকা পাঠাই, কিন্তু তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আরবের নিয়োগদাতারা মাসিক ২ হাজার ৭০০ রিয়েলে ফিলিপাইন থেকে গৃহপরিচারিকা নিয়োগ দিতে ইচ্ছুক হলে, একই নিয়োগদাতাই বাংলাদেশ থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০০ রিয়েলের বেশি খরচ করতে রাজি নন।" বলেন তিনি।
আরবি বা ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে অভিবাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিৎ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এবং অন্তত মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই বিদেশে বাংলাদেশিদের গৃহপরিচারিকার কাজ নেওয়া উচিৎ। "
শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, " মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্যই কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সাধারণ শিক্ষা থেকে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা আলাদা হওয়ায় মাত্র অল্প কিছু শিক্ষার্থী এ শিক্ষার সুযোগ পায়।ফলে আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অদক্ষ। এই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে অন্য দেশগুলো,"
"আমরা শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশগুলোর একটি, কিন্তু এর কারণ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১.২ কোটি অভিবাসী শ্রমিক আছে। এদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে পারলেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবো।"
কোভিড পরবর্তী যুগে স্বাস্থ্য খাতের কর্মীর চাহিদা বেড়ে যাবেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশি একজন অভিবাসী শ্রমিকদের অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় খরচ হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে সময় লাগে গড়ে ১৭.৬ মাসেরও বেশি।
বিদেশে কাজ পেতে অভিবাসীদের গড়ে ৪.১৭ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। বিদেশে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিলে এ অর্থ পুনরুদ্ধারে আরও কথা কম সময় লাগতে পারে এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
অধিক দক্ষতায় অধিক উপার্জন
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিক আছে সৌদি আরবে, এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ।
বিবিএস ও আইএলও'র তথ্যানুযায়ী, সৌদিতে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের ৯০ শতাংশই অদক্ষ। একজন প্রবাসীর মাসিক আয় গড়ে ২২ হাজার ১৪০ টাকা। অন্যদিকে, মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে দক্ষতার অভাব রয়েছে ৮৬ শতাংশের, দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের আয় মাসপ্রতি অন্তত ২৩ হাজার ৮৯৬ টাকা।
এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, দক্ষ শ্রমিকদের উপার্জনও বেশি, যার সুফল দেখা যায় দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহেও।
অভিবাসীদের প্রশিক্ষণে সরকারি উদ্যোগ
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনে দেশে ৭১টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) আছে। তাসত্ত্বেও হাজার হাজার শ্রমিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএমইটি'র মহাপরিচালক (ডিজি) মো শামসুল আল্ম বলেন, " দেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ৫৫টি খাতের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর এতো বিশাল সংখ্যক বিদেশ গমনে ইচ্ছুকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সামর্থ্য নেই,"
"প্রতি ব্যাচে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য আসন খালি থাকে, কিন্তু প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে যান। প্রত্যেক উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা আছে আমাদের। চল্লিশটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে। এছাড়াও আরও ১০০টি কেন্দ্রের জন্য ভবন ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। " বলেন তিনি।
বেশিরভাগ মানুষই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ব্যাপারে না জানার কারণেই প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমান বলে মন্তব্য করেন তিনি।