ভারতীয় অর্থনীতির ক্রান্তিলগ্নে কৃষকদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন মোদি
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এবং আরো কয়েকটি শহরের প্রধান প্রধান সংযোগ সড়কে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন লাখ লাখ কৃষক। প্রতিবাদের মুখে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সুরক্ষা ও আন্দোলনকারীদের অগ্রযাত্রা বন্ধে বসানো হয়েছে ব্যারিকেড ও কাঁটাতারের বেষ্টনী। সঙ্গে আছে দাঙ্গা- প্রতিরোধী বাহন। উত্তেজনার মধ্যে সকল পক্ষের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে প্রতিদিনই শক্তি বাড়ছে অসন্তোষের। আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন আরও কৃষক, আসছে ট্রাক্টরের বহর।
সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে জন-অসন্তোষ উস্কে দেওয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রে এটাই প্রথম নয়, তবে এই আন্দোলনই তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষকদের দাবি গত সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্টে পাস করা কৃষি বিলগুলো বাতিল করতে হবে, কারণ এর মাধ্যমে তাদের জীবিকা ধ্বংসের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, আইনগুলো উৎপাদনকারীদের লাভবান করবে, এই যুক্তিতেই তারা সেগুলো বাতিলে নারাজ।
কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ চলাকালে ১০ দফা আলোচনা হয়েছে। কৃষি সংস্কারের বিলগুলো বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার আদেশও দেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। তার প্রতিক্রিয়ায় সরকার বলেছে, তারা কিছু পরিবর্তন আনবে এবং বাস্তবায়নের তারিখ আরও ১৮ মাস পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে অসন্তুষ্ট কৃষকেরা এমন আপোষে মত দেয়নি। তারা জীবিকার প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতেও নারাজ।
৫০ বছরের বালউইন্দার সিং পাঞ্জাবে তিন একর জমির মালিক। সেখানে তিনি ভারতের প্রধান দুই খাদ্য শস্য ধান ও গমের চাষ করেন। পাঞ্জাবে এ দুটিই প্রধান ফসল। গত ২৬ নভেম্বর থেকে তিনি দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। দিল্লির বাইরে এ সীমান্ত হয়ে উঠেছে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। বালউইন্দার বলেন, "আমরা কোথাও যাচ্ছি না। দরকার হলে এখানে বছরের পর বছর বসে থাকব। সরকারকে অবশ্যই আমাদের দাবি মেনে নিতে হবে। কারণ, আমরা করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে পারি, কিন্তু কৃষি সংস্কারের বিল আমাদের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝোলাবে।"
বিক্ষোভকারীদের ভয় আর সরকারি প্রচারণার নেপথ্যে লুকিয়ে আছে; কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থা পরিবর্তনের তাগিদ। না হলে; অতি-উৎপাদনের চাপে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হবে বিশাল এক উর্বর অঞ্চল। ঘাটতি দেখা দেবে দেশটির ৯০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি সরবরাহে। তাছাড়া, কৃষি সহায়ক প্রণোদনার বার্ষিক বরাদ্দের ভারও তাতে দূর হবে। সঠিকভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হলে, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে লাখো কৃষক পরিবার, বিশ্বে খাদ্য রপ্তানির অগ্রভাগে চলে আসবে ভারত। আর ভুল হলে, অভাবের তাড়নায় জমি-জমা, বসতবাড়ি বিক্রিতে বাধ্য হবে একই সংখ্যক পরিবার।
দিনে দিনে বিষবৃক্ষের আকার ধারণ করা এই সমস্যাটি এতো বিশাল যে, ইতোপূর্বের সকল সরকার তা অর্থপূর্ণভাবে বদলানোর সাহস দেখায়নি। তবে সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় মোদি তাতে বিচলিত হননি। মহামারির মধ্যেও তার প্রশাসন এই ঝুঁকির পাল্লায় পা রাখে।
মোদির ক্ষেত্রে এমন ধারা বরাবর তার কৌশলের অংশ। গত ছয় বছরের শাসনামলে তিনি এমন কিছু নীতি সংস্কারের উদ্যোগ নেন, যা জাতীয় পর্যায়ে বিক্ষোভের শুরু করে, সারাদেশে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। বাজারে প্রচলিত ৮৬ শতাংশ নোট বাতিল এবং ধর্ম-ভিত্তিক নাগরিকত্ব আইন ছিল যার মধ্যে অন্যতম। এর কোনটাতেই আপোষের মনোভাব দেখায়নি মোদি সরকার। কিন্তু, নতুন কৃষি আইনের ক্ষেত্রে আপোষের ইঙ্গিত দিয়ে সরকার পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিল বিষয়টির জটিলতা। কারণ, এই পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হতে পারে ১৩০ কোটি জনতার অর্ধেক, যাদের জীবিকা কৃষি খাতের উপর নির্ভরশীল।
সরকার আর কৃষক আন্দোলনের পক্ষের শক্তি যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। সরকার বলছে, সংস্কারের ফলে ভারতে ফসল উৎপাদন ও বিক্রির প্রচলিত কাঠামো বদলে যাবে। কয়েক দশকের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ফসল ক্রয় পদ্ধতির জায়গায় আসবে বেসরকারি খাতের প্রাধান্য। উৎপাদনকারী তাতে ফসলের প্রতিযোগিতামূলক উচ্চ দাম পাওয়ার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে, কৃষকের ভয় এসব আইনে বৃহৎ পাইকারি ক্রেতা এবং বেসরকারি সংস্থার হাতে এমন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে; যা ক্ষুদ্র ভূমি মালিক কৃষকের উৎপাদিত ফসলের দর নিয়ন্ত্রণ করবে। আর ক্ষুদ্র কৃষকেরাই হচ্ছেন সিংহভাগ উৎপাদক।
বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী বার্কলেইজ এর মুম্বাই শাখার প্রধান অর্থনীতিবিদ রাহুল বাজোরিয়া বলেন, দানাদার শস্য উৎপাদন প্রধান অঞ্চলে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, যেমন; ফলন সহায়ক বীজ, এবং কম পানি সেচের মাধ্যমে একই পরিমাণ শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করা- সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। কৃষি খাতে অগ্রগতির জন্য দরকার রপ্তানি বৃদ্ধি, লক্ষ্যটি অর্জনে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং মান নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।"
তবে দেশটির কোটি কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সংগ্রামী এবং সরকারি মূল্য সহায়তা ও প্রণোদনার উপর তাদের নির্ভরশীলতা দীর্ঘদিনের। অনেকক্ষেত্রে, এ সহায়তায় তারা বছরের পর বছর ধরে বেঁচে আছেন এবং শস্য উৎপাদন করতে পারছেন।
বালউইন্দার বলেন, "বেসরকারি সংস্থা সঠিক সময়ে মূল্য পরিশোধ করবে না। আর ঠিক সময়ে দাম না পেলে আমরা পরের মৌসুমে কীভাবে চাষাবাদ করবো? এমন পরিস্থিতিতে অনাহারে মৃত্যুই হবে আমাদের পরিণতি।"
বিরোধের বীজ লুকিয়ে আছে পাঁচ দশকের পুরোনো ব্যবস্থায়, ১৯৬০ সালের 'সবুজ বিপ্লবের' সময়ে যা চালু করা হয়। তার আগে ভারতের নানা অংশে দেখা দিত দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব, তাই কৃষককে সার ও সেচের বিদ্যুতে সরকারি সহায়তা দিয়ে এবং উৎপাদিত দানাদার শস্যের বড় অংশ সরকারিভাবে কেনার নীতি নেওয়া হয়। তার সুফল পেয়ে আজ বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক আর দ্বিতীয় বৃহৎ গম ও আখ উৎপাদক হয়ে উঠেছে ভারত। তবে একইসময়ে, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা অর্পাযপ্ত হয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রিত বাজার গড়ে ওঠে। সরকারের কল্যাণমুখী বাজেটে যুক্ত হয় দিনে দিনে বেড়ে চলা বিশাল খরচের চাপ। মোদি সেই ধারাবাহিকতাকে ভাঙতে চান।
বর্তমান ব্যবস্থার আওতায় অন্তত দুই ডজন শস্যের ন্যূনতম মূল্য বেধে দেয় সরকার। কৃষি সহায়ক নীতির আওতায় সেই মূল্যেই কেনা হয় বিপুল পরিমাণে চাল ও গম। বেসরকারি ক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্য পরিশোধে বাধ্য না হলেও, সরকারি ক্রয়ের পরিমাণ বিশাল হওয়ায় বাজার সেই মূল্যেই পরিচালিত হয় এবং তাতে ক্ষুদ্র চাষিরা দানাদার শস্যের দাম পেয়ে উপকৃত হন। এই কৃষকেরা নির্ধারিত বাজারে লাইসেন্সকৃত ক্রেতার কাছেই শস্য বিক্রি করেন।
কৃষি আইনে এসব বাজার বেসরকারি খাতের কৃষি সংস্থা ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের জন্য উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র মজুদকারীদের প্রভাব মোকাবিলা করা যাবে। মধ্যসত্ত্বভোগী ক্ষুদ্র মজুদকারীদের প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে, আর পাইকারি ক্রেতারা প্রতিযোগী মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে একজোট হয়েই তা করছে। ফলে চাল ও গমের দর বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায় স্থিতিশীল অবস্থানে রয়ে গেছে। অন্যদিকে, কৃষকেরা উচ্চ দর না পাওয়ায় সরকারি সহায়তার উপর পড়ছে বাড়তি চাপ। একইসময়ে, মধ্যসত্ত্বভোগী নিয়ন্ত্রিত নয় এমন কিছু শস্য যেমন; সয়াবিন, ভুট্টা এবং সর্ষের দর ওঠানামা ছিল স্বাভাবিক বিষয়।
কৃষকেরা সরকারি ব্যবস্থাতে আস্থা রাখেন, কারণ সরকার অন্তত তাদের নিশ্চিত দরদাতা ক্রেতা। নিশ্চিত দাম পাওয়ায় তারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে ছোট আকারে ঋণও নিতে পারেন। ভারতের মতো বিশাল দেশে যেখানে সব জায়গায় গ্রামীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা নেই, সেখানে বীজের মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে এমন ঋণের সুযোগ কৃষকের কাছে বাঁচামরার প্রশ্ন।
তবে নতুন আইনে নির্ধারিত বাজারের বাইরে শস্য বিক্রির উদারনীতি রাখা হয়েছে। তারপরও, প্রণোদনা ও কৃষি কল্যাণকর সাহায্য-সহযোগিতা ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোদি প্রশাসন। কিন্তু, বিক্ষোভকারীরা তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
তাদের অধিকাংশ মনে করেন, আলোচিত সংস্কার সরকারি ব্যয় সঙ্কোচনের পদ্ধতি মাত্র। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি ব্যবস্থার সাহায্যে বাজারে দরপতন ঘটিয়ে খাদ্যে প্রণোদনার খরচ ৩৩.৪ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমান কৃষি সহায়তার আওতায় ৫০ শতাংশ মুনাফাসহ উৎপাদন মূল্য পরিশোধ করে সরকার। ফলে নির্দিষ্ট কিছু ফসল অধিক পরিমাণে ফলানোর উৎসাহ পান কৃষক। এতে স্থানীয় চাহিদার চাইতেও বেশি চাল, গম, আখ ও তুলা উৎপাদন হচ্ছে ভারতে। বেসরকারি সংস্থার জন্যে বাজার উন্মুক্ত করা মাত্র এসব শস্যের দরপতন প্রায় নিশ্চিত। কৃষকের ভয়টা তাই সমূহ বিপদের আশঙ্কা থেকেই।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ