ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ যাত্রায় ওয়েস্টার্ন মেরিন
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে, কোলাগাঁও আসলে- এখন চোখে পড়বে পটিয়া মেরিন শিপ বিল্ডার্স। পরিচিতজনদের যারা এক বছর আগেও এখানে এসেছেন প্রথমেই মনে হবে ভুল কোন জায়গায় এসেছেন- কারণ এক বছর আগেও এই স্থান ছিল ৩,০০০ শ্রমিকের কর্মব্যস্ত এলাকা। শ্রমিকদের কোলাহল, জাহাজ নির্মাণের শব্দ এখন সেই সব কিছুই নেই। এখানেই ৪০ একর জায়গা জুড়ে গত ২০ বছর ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ইয়ার্ড।
প্রায় ১৫০টি জাহাজ নির্মাণ করে দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, কেনিয়া, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, আরব আমিরাত ও ভারতসহ ১২টি দেশে ৩৩ টি জাহাজ রপ্তানি করে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এতে ১৪০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রাসহ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এখানে ঝুলছে পটিয়া মেরিন শিপ বিল্ডার্সের সাইনবোর্ড।
বৃহষ্পতিবার সরেজমিন পৌঁছতেই দেখা যায়- নদী থেকে উঠতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান গেট বন্ধ করে সেখানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে পটিয়া মেরিন শিপ বিল্ডার্স। এরপর ইয়ার্ডের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় এক সময় ওয়েস্টার্ন মেরিনের ইয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার হওয়া অর্ধেকেরও বেশি জায়গায় দেয়াল তুলে দিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। সাইনবোর্ডে মালিক হিসেবে হাজী ছাবের আহমদের নাম লেখা রয়েছে।
এক সময় কারখানা জুড়ে হাজারো শ্রমিকের কর্মযজ্ঞ চললেও গতকাল কোন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায় নি। পুরো কারখানা ও কার্যালয় মিলে ১৫-২০ জন কর্মকর্তা-শ্রমিক দেখা গেছে। যারা মূলত দাপ্তরিক ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। শুধুমাত্র ওয়েস্টার্ন মেরিনের কর্মীদের বেতন ও লেনদেনকে ঘিরে এক সময় ইয়ার্ডের ভেতরই একটি এটিএম বুথ স্থাপন করে ব্যাংক এশিয়া। লেনদেন না থাকায় সম্প্রতি বুথটি বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংক।
অভিযোগ রয়েছে- গত ১৩ মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় তিন হাজার শ্রমিক-কর্মকর্তার ৮-১০ কোটি বেতন বকেয়া হয়ে পড়েছে। একই সময়ে ইয়ার্ডের জন্য লিজ নেয়া জমির ভাড়াও পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের এক পরিচালক বলেন, ৪০ একর জায়গার মধ্যে ২৮ একর প্রতিষ্ঠানের নামে কেনা। বাকি ১২ একর জমি ৩০ বছর চুক্তিতে ভাড়া নেয়া হয়। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে মাসিক ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় ভূমি মালিক হাজী ছাবের আহমদ তার জায়গায় সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এছাড়া আরো এক ভূমি মালিক একই কারণে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে তার জায়গা ছেড়ে দিতে বলেছে।
দেশের সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে ২০০০ সালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন । গত বিশ বছরে কার্গো ভেসেল, প্যাসেঞ্জার ভেসেল, মাল্টি পারপাস আইস প্লাস ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্র্যাফট, ওপসোর পেট্রোল ভেসেল, ট্যাগ বোট, ফিশিং ভেসেল, বাল্ক কেরিয়ার এবং কন্টেইনার কেরিয়ারসহ বিভিন্ন মানের ১৫০ টি জাহাজ নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৮ সাল থেকে ১২টি দেশে রপ্তানী করে ৩৩ টি জাহাজ।
কিন্তু সম্প্রতি পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অব্যবস্থাপনা, স্বল্পমেয়াদি চড়া সুদের ঋণ দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় জাহাজ নির্মাণকারী এই প্রতিষ্ঠান।
এত সম্ভাবনার পরও বর্তমানে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাবে প্রায় বন্ধের পথে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের বর্তমান পরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন প্রায় ১৯ বছর এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
বোর্ড মিটিংয়ে তার বিরুদ্ধে এক পরিচালক অভিযোগ তুলেন তিনি অর্ডার বাড়াতে পারেন নাই এবং কমাতে পারেন নি ব্যাংক লোন। ২০১৯ সালের জুনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছেড়ে দেন।
নতুন দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন (অব:) সোহেল হাসান। স্ব-পরিবারে সিঙ্গাপুর থাকেন সোহেল । করোনাকালে বেতনের জন্য শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে প্রতিষ্ঠানের সামনে; তখনও সোহেল সিঙ্গাপুর ছিলেন । এদিকে ২০১৯ সালে নতুন এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্ব নেওয়ার পর কোন জাহাজ রপ্তানী করতে পারে নাই ওয়েস্টার্ন মেরিন।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, '২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত আমি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। ওই সময় পর্যন্ত জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন মেরিন একটি আর্ন্তজাতিক ব্রান্ড হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু গত দেড় বছরে প্রতিষ্ঠানটি একটি জাহাজও রপ্তানি করতে পারে নি। উল্টো সময়মতো জাহাজ সরবরাহ দিতে না পারায় ওয়েস্টার্ন মেরিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এতে আমাদের দীর্ঘদিনের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে'।
জাহাজ নির্মাণ খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগের পর লাভের ধারায় পৌঁছতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংক থেকে চড়া সুদে স্বল্প মেয়াদী ঋণ নিয়ে ইয়ার্ড তৈরিসহ দীর্ঘ মেয়াদী প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছে ওয়েস্টার্ন মেরিন।
অথচ অদক্ষ জনশক্তি ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে ছয়মাসের একটি জাহাজ নির্মাণে কখনো কখনো দেড়-দুই বছর সময় লাগে। চুক্তির নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতাকে জাহাজ সরবরাহ করতে না পারলে জরিমানা কিংবা লোকসানে জাহাজ বিক্রি করতে হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি জাহাজ নির্মাণ করে বিক্রির আগেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য নেয়া ব্যাংক ঋণ খারাপ হতে শুরু করে। এরপর এক ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এভাবে একটির পর একটি ব্যাংক বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ঋণের আকারও।
প্রতিষ্ঠানটির ইন্ডিপেনন্ডেট ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানকে টেকসই পর্যায়ে নিতে অন্যান্য দেশের মত সরকারের সহযোগিতা ছিল না'।
ঝুঁকিতে পাওনদার ব্যাংক
গত দেড় বছর ধরে জাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় ঋণ আদায়ের ঝুঁকিতে রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিনে বিনিয়োগ করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছে এই পর্যন্ত ১৯ ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই ঋণের বেশিভাগই (বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবৃদ্ধি ও নীতি বিভাগের বিআরপিডি সার্কুলার-৪ অনুযায়ী) দীর্ঘ মেয়াদী রিস্ট্রাকচার ও রিসিডিউল করেছে ব্যাংকগুলো। তবে ঋণের একটি অংশ ইতোমধ্যে আবারো শ্রেণিকৃত (ওভারডিউ ও বিএল) হয়ে পড়েছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছে বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৭২১ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ৪৪৮ কোটি, সোনালী ব্যাংক ১১৭ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১১১ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের ৭২ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৬৩ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংকের ৫৩ কোটি টাকা, মাইডাস ফিন্যান্স ৪৫ কোটি, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ৩৬ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার লিজিং এন্ড ফাইন্যান্স ৩২ কোটি টাকা, রিলাইন্স ফাইন্যান্স ২২ কোটি টাকা, ফারইস্ট ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ১৭ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ১৩ কোটি টাকা, উত্তরা ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ১১ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ৫ কোটি টাকা, ব্রাক ব্যাংক ৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট এর দুই কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
ব্যাংক ছাড়াও ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছে খাত সংশ্লিষ্ট ১৫-২০ ব্যবসায়ীর অন্তত ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে আটলান্টিক মেরিনের কর্ণধার নাছির উদ্দিন ৮০ লাখ টাকা, দেশ শিপ বিল্ডিংয়ের কর্ণধার মো সরওয়ার আড়াই কোটি টাকাসহ আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী ওয়েস্টার্ন মেরিনের বিরুদ্ধে ৮-১০ টি চেক ডিজনার মামলা দায়ের করেছে।
ব্যাংক এশিয়ার ইভিপি ও জোনাল হেড এ কে এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'ঋণের টাকায় জাহাজ নির্মাণ করে কর্ণধাররা লাভবান হলেও সময়মতো ব্যাংক ঋণ শোধ করেনি। যেই কারণে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের ভারে জর্জরিত'।
সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম মো. মনির হোসাইন বলেন, 'শুরুতে ভালো ব্যবসা করায় প্রতিষ্ঠানটিকে সহজে ঋণ দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু সম্প্রতি পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধে প্রতিষ্ঠানটির নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন ঋণ শোধ করতে পারছে না। পাশাপাশি অব্যবস্থাপনার কারণে নতুন কোনো জাহাজ নির্মাণ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি'।
দেশি-বিদেশি ৮ টি জাহাজ ডেলিভারী অনিশ্চিত
গত দেড় বছর ধরে নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে অর্ডার নেয়া দেশি-বিদেশি ৮ টি জাহাজ ডেলিভারি দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। নেই কোন নতুন অর্ডারও।
চুত্তির সময় অনুযায়ী জাহাজ সরবরাহ করতে না পারায় ২০২০ সালের জুন মাসে হাইকোর্টে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুবাইভিত্তিক আল রশিদ শিপিং লিমিটেড।
এর সাথে এস আলম গ্রুপের এভার গ্রিন নামের একটি কার্গো ভেসেল, বিআইডব্লিউটিসি'র একটি প্যাসেঞ্জার ভেসেল, চট্টগ্রাম বন্দর ও পায়রা বন্দরের ২ টি ট্যাগ বোট ও সেনা বাহিনীর একটি ল্যান্ডিং ক্র্যাফ্টের ডেলিভারি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপন পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব:) সোহেল হাসান বলেন, 'করোনা মহামারীর কারণে বিদেশি দক্ষ শ্রমিকরা এখনো কাজে ফিরে নি। এতে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে জাহাজ দুটি হস্তান্তর করা সম্ভব হয় নি। কাজ বন্ধ থাকার পরও করোনাকালীন সময়ে শ্রমিক-কর্মকর্তাদের বেতন ও কারখানার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। তাই আমরা আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছি। তবে দ্রুত আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। সরকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য 'শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভলপমেন্ট পলিসি' প্রণয়ন করছে। যেখানে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকছে'।