নর্থ এন্ড: নগরের কফি সংস্কৃতি বদলে দিয়েছে যে ক্যাফে
ধোঁয়া ওঠা এককাপ তাজা কফিতে মিশে থাকে অজস্র অনুভূতি। তবে সে কফির মুগ্ধতা সবাইকে বাণিজ্যের পর্যায়ে টেনে আনে না। আর তা যদি ঘটে অন্য দেশের মাটিতে, তবে সে তো আরও দুর্লভ ব্যাপার।
নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্সের প্রতিষ্ঠাতা রিক হাবার্ডের গল্পটা এমনই। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগে বারিসতা (কফি পরিবেশনকারী) এবং কফি রোস্টার হিসেবে কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
কফির প্রতি নিজের অনুরাগ বুঝতে সময় লাগেনি রিকের; স্ত্রী ক্রিস আবার পেস্ট্রি তৈরিতে দক্ষ। ব্যস, দুজনে মিলে বিদেশের মাটিতে কফি শপ গড়ে তোলার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
২০০১ সালে প্রথম এ দম্পতি বাংলাদেশে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসেন; সে সময়ই তারা এখানে ব্যবসার জন্য মনস্থির করেন। কিছুটা সময় তারা এখানকার বাজারের গতিপ্রকৃতি বোঝার পেছনে ব্যয় করেন; এরপর ২০০৯ সালের মধ্যে তাদের ব্যবসার পরিকল্পনা তৈরি হয়ে যায়।
মার্কিন দূতাবাসের পাশে প্রগতি সরণি, শাহজাদপুরে নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্সের প্রথম শাখা উদ্বোধন করেন তারা। সেটি ২০১১ সালের কথা। শুরুতে তাদের পরিকল্পনা ছিল স্বল্প পরিমাণে অর্থাৎ ছোট ছোট ব্যাচে একদম তাজা কফি পরিবেশনের।
অল্প সময়ের ভেতরেই এটি বাংলাদেশে বসবাসরত প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু কফিই নয়, এখানকার সিনামন রোল প্রতিদিনই বেক করতে হতো তাদের; ফলে শিগগিরই স্থানীয়রাও ভিড় করতে লাগলেন এ কফিশপে।
রিক খেয়াল করলেন, মানুষ শুধু কফি খেয়েই সন্তুষ্ট নয়, তারা এর সঙ্গে স্ন্যাকজাতীয় হালকা নাশতাও চায়। স্ত্রী ক্রিসের তো বেকিংয়ে দক্ষতা ছিলই। নর্থ এন্ডের মেন্যুতে তাই মনকাড়া স্বাদের ব্যাগলস, ক্রোইসান্টস আর ব্রাউনি যুক্ত হতে সময় নিল না।
মানুষের সাড়ায় অভিভূত হয়ে পড়লেন রিক-ক্রিস দম্পতি। উদ্বোধনের মাত্র দ্বিতীয় বছরেই নর্থ এন্ড তার দ্বিতীয় শাখাটি খুলে ফেলল; তার পরের বছর তৃতীয়টি। বর্তমানে ঢাকার ভেতরে এই কফিশপের আটটি শাখা রয়েছে; কক্সবাজারের উখিয়াতে রয়েছে আরেকটি।
ক্যাফে হিসেবে নর্থ এন্ড জনপ্রিয় হলেও অধিকাংশ মানুষই জানে না, এটির ব্যবসায়িক নীতির অন্যতম বড় দিক কিন্তু কফিবিন রোস্টিং এবং সরবরাহ করা। এখানকার বেশিরভাগ কফি বিনই সিঙ্গাপুর ও ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়। সেগুলো এখানে এনে প্রথমে রোস্ট করা হয়। ঢাকার অনেক অভিজাত হোটেল ও ক্যাফে মালিক নর্থ এন্ডের কাছ থেকে সেসব রোস্টেড কফিবিন কিনে নেন। প্রতি মাসে প্রায় ছয় টনের মতো কফি রোস্ট করা হয়। মূলত অ্যারাবিকা কফিই আমদানি করেন তারা।
প্রথম থেকেই ক্রেতাদের মাঝে নর্থ এন্ড একটি উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চেয়েছে। এমন একটি আবহ তৈরি করতে চেয়েছে, যেখানে কফি খেতে খেতে নিতান্ত অপরিচিতজনেরাও নিজেদের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসি দেবে।
এখানেও তাই নর্থ এন্ড অনন্য। কফি বা স্ন্যাকসের অর্ডার যত স্বল্পই হোক, এ কফিশপ তার ক্রেতাদের কখনো উঠে যেতে বলে না। কফিতে চুমুক দিতে দিতে যতটা সময় ইচ্ছা, তারা নর্থ এন্ডের ভেতরে কাটাতে পারেন। ফলে নর্থ এন্ডের ভেতরে বসেই ল্যাপটপে অফিস বা ক্লাসের কাজ করছেন- এমন দৃশ্য খুবই সাধারণ।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের গল্প শোনা হলো, নর্থ এন্ডের কফি না হলে যার নাকি সকালটাই জমে না! যেদিন তার গলা দিয়ে এ দোকানের কফি নামবে না, সেদিন তার ছাত্রদের জন্য এক ভয়ানক দিন!
নর্থ এন্ডের ক্রেতাদের মাঝে অবশ্য বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। শিক্ষার্থী থেকে চাকুরিজীবী- সব ধরনের ক্রেতাই ঢুঁ মারেন এখানকার কফির স্বাদ নিতে।
নর্থ এন্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিক হাবার্ড বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, কফি কোনো বিলাসিতা নয়। আমাদের এখানে ১০০ টাকার কমেও খাবারের আইটেম রয়েছে। ক্রেতার স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আমাদের সর্বাগ্রে মনোযোগ। আমাদের কর্মীরাও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এমনকি ছোট একটা বাচ্চা যদি এখানে এসে মেঝেতে কিছু ফেলে, আমরা কোনো উচ্চবাচ্য করি না। উলটো এমন প্রতিক্রিয়া দেখাই, যেন এটি নিতান্ত সাধারণ একটি ব্যাপার।'
'আমরা প্রতিটি ক্রেতার প্রতিটি চুমুকের দিকে নজর রাখি,' বলেন তিনি।
নর্থ এন্ড যে কফি পরিবেশন করে, তা দোকানের তাকেই সাজানো দেখতে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি যে কফি আকর্ষণ করে, সেটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্লেন্ড করা বিশেষ কফি। এই প্রতিষ্ঠান এ দেশের পার্বত্য অঞ্চলের চাষীদের সাহায্যেও এগিয়ে। স্থানীয়ভাবে অধিক কফি উৎপাদন করাটাই তাদের লক্ষ্য।
'একটি অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কফি খুব তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাংলাদেশে উন্নতমানের কফি উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। আমার প্রথম ব্যাচের কফি চট্টগ্রামেই রোস্ট করেছিলাম। সেখানকার চাষীদের কফি চাষে আমি উৎসাহ দিই। আমরা তাদের বীজ সরবরাহ করি। গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পেয়েছি।'
এর আগে ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিক বলেছিলেন, বাংলাদেশের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে জন্মানো কফির মান মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় জন্মানো কফির মতোই।
নর্থ এন্ডের প্রথম খোলা শাহজাদপুরের শাখাটিতে এখন একটি কফি একাডেমিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনেক স্থানীয় কফি ব্যবসায়ী এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। রিক জানালেন, এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে কফি বাণিজ্যের সম্প্রসারণে অবদান রাখতে পেরেছেন।
'এখানে যেমন আমাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অন্যদের জন্যও রয়েছে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ,' বলেন তিনি।
নর্থ এন্ডের এই এক দশকব্যাপী সাফল্যের সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই। এদেরই একজন রাজোয়ান হাসান, যিনি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে বারিসতা হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি হেড অব সেলস পদে অধিষ্ঠিত।
বিপণনে স্নাতক সম্পন্নের পর কফিশপে কাজ করার ব্যাপারে তার মধ্যে যে দ্বিধা ও সংকোচ কাজ করছিল, সেটি স্বীকার করে নিলেন রাজোয়ান ।
তিনি বলেন, "কাজ শুরুর পর অবাক হয়ে দেখতাম, ক্রেতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদেরকে কখনো উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে নর্থ এন্ড অনেক ক্রেতার কাছেই রীতিমতো 'সেকেন্ড হোমে' পরিণত হয়েছে।"
কথা বলতে বলতেই রাজোয়ান দূরে বসে থাকা এক ক্রেতাকে দেখালেন। জানা গেল, ওই ব্যক্তি প্রতিদিন ক্যাফে খোলার সময় এসে উপস্থিত হন এবং রাতে বন্ধের সময় একবারে বেরোন। এখান থেকেই তিনি তার অফিসের কাজ সারেন, শুধু দুপুরে একবার খাবারের বিরতিতে যান।
গত বছর লকডাউনে যখন অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো নর্থ এন্ডও বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন এই ব্যক্তি প্রতিদিন নর্থ এন্ড পুনরায় খোলার ব্যাপারে জানতে চাইতেন।
রাজোয়ান শোনালেন আরও একটি অনুপ্রেরণার গল্প: 'একদিন দেখলাম, আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (রিক) নিজে টয়লেটের মেঝে পরিষ্কার করছেন। সেদিন বুঝতে পারি, কাজের প্রতি একাগ্রতা কাকে বলে! ওই দিনের পর থেকে আমি আমার কাজ ভালোবেসে মানুষকে খুশি রাখতে শুরু করি।'
রিকের কথার রেশ ধরে রাজোয়ানও জানালেন, নর্থ এন্ডের লক্ষ্য দেশে একের পর এক শাখা খুলে যাওয়া নয়; বরং তারা দেশে কফিকে ঘিরে একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চান, যেখানে স্থানীয় কফি চাষীদের তত্ত্বাবধান এবং উৎসাহ প্রদানও করা হবে।