নারী শুধু অধীনস্থ নয়!
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও দেশে পত্রিকা কিংবা নিউজ চ্যানেল খুললেই প্রতিদিনই জানা যায় একাধিক মর্মান্তিক ধর্ষণের ঘটনা। ক'দিন আগেও আমরা দেখেছি, জাতীয় শহীদ মিনার- যা কি না আমাদের কাছে জাতিগতভাবে সর্বোচ্চ গর্বের প্রতীক, সেই স্থানেই এক শিশুকে ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেই ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ফলে ধর্ষণ কমে আসবে বলে কেউ কেউ মনে করেছিলেন।
ওই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, মানুষের মন যদি বোধহীনতা আর কদর্যতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তাহলে কঠোর শাস্তি দিয়েও অন্যায় কমানো যায় না।
মানুষের মনে শুভবোধ ও সুরুচি তৈরি করার গুরুদায়িত্ব আমাদের সমাজে বরাবরই অবহেলিত। এই দায়িত্বহীনতার মূল্যই আজ দিতে হচ্ছে আমাদের। মানুষের চিন্তা ও রুচিতে মাধুর্য আসে সৌন্দর্যময় সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবে। অথচ দুঃখজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে প্রযুক্তিগত বিকাশের তুলনায় সাংস্কৃতিক লালিত্য কমছে। বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে এখন যৌন আবেদন আর গ্ল্যামারসর্বস্ব চটকদার আর চটুল উপাদানের প্রভাবে মানুষের আচরণে শোভনতা ও কমনীয়তা থাকছে না।
একজন মানুষের মানসিক বিকাশে ছোটবেলা থেকেই তার চারপাশের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখে। একটা সময় পর্যন্ত এ দেশে নাটক, সিনেমাগুলোর কনটেন্টে বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বশীল আচরণও থাকত। আশি, নব্বইয়ের দশকের বিটিভি প্রচারিত সাপ্তাহিক বা ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখলেও আমরা সবকিছুরই মার্জিত রূপ দেখতে পাই। প্রেম তখনকার নাটক-সিনেমারও কনটেন্ট ছিল, তাই বলে তখনকার নাটক কিংবা সিনেমার সংলাপগুলো বর্তমান সময়ের মতো চটুল আর নিম্নরুচির ছিল না।
আমরা জানি বাণিজ্যিক সিনেমা অধিকতর দর্শকের কাছে পৌঁছবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্যিক সিনেমার বিষয়বস্তু কিংবা কাহিনির দিকে যদি তাকাই, মান্না অভিনীত 'বাঁচাও দেশ' টাইটেলধারী সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা বর্ণনা করা যাক: সেই দৃশ্যে দেখা যায় ভিলেন নায়িকাকে জোর করে তুলে নিয়ে আসে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করতে থাকে। সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ সংলাপের পাশাপাশি একটি কথা এমন, 'তোর ইজ্জত আমি নষ্ট করব আর সেই ছবি মহল্লায় মহল্লায় ছাপাব।' এবং পাশেই একটি ক্যামেরা রাখা থাকে, যার মাধ্যমে ধর্ষণের এই বীভৎসতা ধারণ করা হচ্ছে। এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে।
২০২০ সালে এসে চলচ্চিত্রের সেই দৃশ্য যেন বাস্তবে দেখছি! নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যেতে দেখেছি। এখানে আমরা সিনেমাটির দৃশ্য এবং বাস্তব ঘটনাকে যদি পাশাপাশি রাখি এবং ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিওরিস্ট এলিজাবেথ কাউইর ফ্যান্টাসি থিওরির চিত্রায়ণ উপলব্ধি করি, তাহলে কী পাই? এলিজাবেথ তার ফ্যান্টাসি থিওরিতে বলেছেন, একজন মানুষ সিনেমা দেখার সময় শুধুমাত্র সিনেমায় চিত্রায়িত কোনো অবজেক্টকে পসেস করার কথাই কল্পনা করে না, বরং নিজেকে সিনেমায় চিত্রায়িত সেই নির্দিষ্ট দৃশ্যে কল্পনা করার মাধ্যমে মানসিকভাবে আনন্দ পেতে সাহায্য করে। তাহলে আমরা বলতে পারি, 'বাঁচাও দেশ' সিনেমাটিতে মিশা সওদাগর যখন ওই সংলাপ দিচ্ছিলেন, তখন দর্শকসারিতে বসা অনেক বিকৃত রুচির দর্শক হয়তো নিজেকে সেই স্থানে কল্পনা করে আনন্দ পেয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা উচিত, বেশিরভাগ সময়ই মিডিয়ায় নারীকে পণ্য হিসেবে চিত্রায়ণের চেষ্টা আমরা দেখতে পাই, যা লরা মালভিস তার মেইল গেইজ থিওরিতে উল্লেখ করেছেন। একই দৃশ্য যদি আমরা লরা মালভিসের মেইল গেইজ থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে যাই, তখন দৃশ্য চিত্রায়ণের সময় দেখব নায়িকাকে এমনভাবে শোয়ানো হয়েছে এবং ক্যামেরা ঠিক নিচ থেকে এমন অ্যাঙ্গেলেই ধরা হয়েছে, কোনোভাবেই এটা 'মেইল গেইজের' জন্য বিব্রতকর কিংবা ভয়ের উদ্রেক করবে না; বরং নারী শরীরের দিকেই দৃষ্টিকে নিবব্ধ করবে।
ধর্ষণের ঘটনা যে কোনো মেয়ের জন্যই অত্যন্ত বিভীষিকাময়, অথচ আমাদের দেশে এখনো চলচ্চিত্রে হামেশাই ধর্ষণকে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং প্রায় প্রতিটি বাণিজ্যিক সিনেমাতেই একটি ধর্ষণের দৃশ্য রাখার প্রবণতা রয়েছে। ফলে সমাজে এইসব চলচ্চিত্র দেখে বেড়ে ওঠা পুরুষদের নারীদের প্রতি কীরূপ আচরণ হবে, তা ধারণা করা যায়।
বাণিজ্যিক সিনেমার কথা রেখে আমরা যদি তথাকথিত মধ্যবিত্ত সমাজের দর্শকদের বর্তমান রূচির দিকে তাকাই, তাহলে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত নাটকগুলো চাকচিক্যময় স্থুলতাসর্বস্ব কনটেন্টে ভরপুর। তরুণ-তরুণীদের প্রেম আর হালকা হাসিঠাট্টাই বেশিরভাগ নাটকের মূল উপাদান- যা অগভীর বিনোদনই শুধু দিতে পারে। এখন কেউ ব্রিটিশ থিওরিস্ট উইলিয়াম স্টিফেনসনের 'প্লে থিওরি' অনুযায়ী বলতে পারেন, গণমাধ্যমের প্রধান কাজ বিনোদন দেওয়া। সারাদিনের কাজ শেষে একটু রিল্যাক্সেশনের জন্যই লোকে গণমাধ্যমের প্রতি ঝোঁঁকে।
হ্যাঁ, মাসমিডিয়ার নাটক-সিনেমা হয়তো বিনোদনেরই মাধ্যম। তবে এখানে বিনোদনের নামে আসলে কী দেখানো হচ্ছে, সেটা মাথায় রাখা জরুরি। বিনোদনের নামে যা ইচ্ছে তা দেখিয়ে দেওয়া সৃষ্টিশীল কোনো কাজ হতে পারে না। বরং চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলাই সৃষ্টিশীলতার চ্যালেঞ্জ।
এ ক্ষেত্রে নিজ দেশের সংস্কৃতি কথাও মাথায় রাখা উচিত। এখনকার নাটকগুলোয় সমসাময়িক কোনো সমস্যার উল্লেখ নেই, নেই ইতিহাসকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা। ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে অবশ্যই সেখানে মূল্যবোধ জাগ্রত হয়- এমন কনটেন্ট থাকা জরুরি।
স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়েও আমাদের গণমাধ্যম ফ্রান্স ফানোর ডিকলোনাইজেশনের এসিমিলেশন পর্যায়েই রয়ে গেছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে 'জীবন থেকে নেওয়া', 'আবার তোরা মানুষ হ', 'মাটির ময়না'- এমন বেশকিছু চলচ্চিত্রের মুখ আমরা দেখেছিলাম, কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা ফানোর কমব্যাটিভ স্টেজ থেকে আজও বহুদূর। শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে নায়িকাকে অভিনয় করালেও পরিচালকরা মেইল গেইজের বাইরে আসতে পারছেন না।
জ্যাকি স্টেসি তার 'ফেমিনিন ফ্যাসিনেশন: আ কোয়েশ্চন অব আইডেন্টিফিকেশন'-এ বলার চেষ্টা করেছেন, একজন নারী দর্শক হিসেবে থিয়েটারে প্রবেশ করলে তার মধ্যে নিজেকে প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টারে দেখতে চাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। নিজেকে সে চরিত্রগুলোর মধ্যে শনাক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। অর্থাৎ, এই তত্ত্বের কথা থেকে আমরা বলতে পারি, গণমাধ্যমে নারীকে সর্বদা দুর্বল, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল চরিত্রের রূপায়ন বাস্তবজীবনের নারীদের ওপরও প্রভাব ফেলে। এই যে ধর্ষণ দৃশ্যগুলো দেখানো হয়, সেখানে কখনোই নায়িকা বা মেয়ে চরিত্রটি নিজে উদ্ধার হতে পারে না, অবশ্যই তার জীবন তখন নায়কের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকে।
নাটকগুলোতে দেখা যায়, জামা-কাপড়, এক্সেসরিজ এবং কোন রেস্টুরেন্টে খাবে- শুধু এইসবই একজন মেয়ের ভাবনার জগত। সে তার প্রেমিককে 'বাবু খাইছো?' 'বাবু চলো না ঘুরতে যাই', 'বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য'- এসব সংলাপেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা সে যত আধুনিক পোশাকই পরুক না কেন। এসব বিষয়ও নারী দর্শকদের ওপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে সমাজে মানসিকভাবে দুর্বল একটি নারী শ্রেণী গড়ে ওঠে, যারা লড়াই করতে জানে না, নিজের সুরক্ষা নিজে করতে জানে না।
এভাবেই মিডিয়ায় উপস্থাপিত নাটক, সিনেমা আমাদের মননে সূক্ষ্মভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছে- নারী অধীনস্থ এবং পুরুষ যা খুশি তাই করতে পারে নারীর সঙ্গে। এভাবেই মিডিয়া ধর্ষণ বন্ধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ তো হচ্ছেই, উল্টো অজান্তেই হয়তো ভুল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।
- লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়