কোভিড-১৯ টিকাদান: দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে বাংলাদেশ
দেশব্যাপী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন শুরুর ১২ দিনে প্রায় ২১ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়েছে বাংলাদেশ শতকরা হিসেবে যা এক শতাংশেরও বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান ভ্যাকসিনেশনে বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের এক শতাংশের কম মানুষ এ পর্যন্ত ভ্যাকসিনেশনের আওতায় এসেছে। শুধু ভারত বা পাকিস্তান নয়, ভ্যাকসিনেশনে নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা'র তথ্য অনুযায়ী, ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে; বিশ্বের মোট জনসংখ্যার হিসেবে যা ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
ওই প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১.২৬% মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা ১.২৩%, ভারত ০.৮%, নেপাল ০.৫৪% ও পাকিস্তান ০.০২% মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আসা এই ৮৬টি দেশের মধ্যে ৫৬টি উন্নত বিশ্বের দেশ, ৩০টি মধ্যম আয়ের দেশ। তবে এ তালিকায় কোনো দরিদ্র দেশ এখনো যোগ হয়নি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, বিশ্বের ১৩০টি দেশ এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনেশনের আওতায়ই আসেনি।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন শুরু করা দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশ মালদ্বীপে এখন পর্যন্ত ৯.২৬% মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে, যা শতাংশের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৫ লাখ, সেখানে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। তাই শতাংশের দিক থেকে বাংলাদেশের দিক থেকে এগিয়ে আছে দেশটি। মালদ্বীপকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিও এখন ভালো রয়েছে। বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের ইনফেকশন রেট ২.৩৩%. চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশে করোনাভাইরাসের ইনফেকশন রেট ৫% এর নিচে। দেশে করোনাভাইরাস এনডেমিক হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এখন দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকাসিনের আওতায় আনা গেলে অন্যান্য দেশের তুলনায় আগে বাংলাদেশ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রন করতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে ইসরাইলে। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা'র তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইজরায়েলের ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ, সিচিলিসে ৬২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৬ দশমিক ১৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, বাহরাইনে ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং সার্বিয়ার ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে গত ২৭ জানুয়ারি ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ। তবে দেশব্যাপী ভ্যাকসিনেশন শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে।
প্রতিদিনই বাড়ছে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা। ২১ জানুয়ারি দুপুর ২:৩০ পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিতে নিবন্ধ করেছেন ৩২ লাখ ৯৪ হাজার মানুষ।
ভ্যাকসিন নেয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ায় ভ্যাকসিনেশন পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে সরকার। প্রথম মাসে ৩৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার লক্ষ্য থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ৬০ লাখ করা হয়েছে।
সারা দেশের ১ হাজার ৫ টি টিকাদান কেন্দ্রে ২৪০০টি দল ছুটির দিন ব্যতীত সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ৪০ বছরের উর্ধ্ব নাগরিকদের কোভিড-১৯ এর টিকা দিচ্ছে।
প্রথম দিন ভ্যাকসিন নেয়া সবাই ভালো আছেন
২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মতিঝিল জোনের পুলিশ সার্জেন্ট মো. দিদারুল ইসলাম (২৮)। ভ্যাকসিন নেয়ার পর কয়েকঘণ্টা হালকা জ্বর ছিলো তার। প্যারাসিটামল খাওয়ার পর জ্বর সেরে গেছে। ভ্যাকসিন নেয়ার পর একদিন ছুটিতে ছিলেন তিনি, তারপর থেকে নিয়মিত অফিস করছেন। তবে কোন ধরণের দুর্বলতা বা ব্যথা হয়নি তার।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত নার্ভাস ছিলাম। তবে ভ্যাকসিন নেয়ার পর ভয় কেটে গেছে। কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই আমি কাজ করে যাচ্ছি। আমার জোনের প্রায় ৯০% পুলিশ সদস্য এরইমধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন।
দিদারুল ইসলামের মত প্রথম দিন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছেন সাংবাদিক মাসুদ রায়হান পলাশ। ভ্যাকসিন নেয়ার ঘণ্টাখানেক পর কাজে ফিরে যান তিনি।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন নেয়ার ২৬ দিন হয়েছে। অনেকের কাছে শুনেছি, টিকা গ্রহণের পর তাঁদের সামান্য জ্বর হয়েছিল। কিন্তু আমার জ্বরও হয়নি। অন্য কোনো সমস্যা চোখেই পড়েনি। আমি বেশ ভালো আছি। আগামী ২৮ মার্চ আমাকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে শুনেছি, অপেক্ষায় আছি।
দিদারুল ইসলাম ও মাসুদ রায়হানের মত ভ্যাকসিনেশন শুরুর প্রথম দিন ভ্যাকসিন নিয়েছেন ২৬ জন। অন্য সবার মতই তাদেরও কারো কারো সামান্য জ্বর, দুর্বলতা ও ব্যথা ছিলো। যা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক(কমিউনিকেবল ডিজিস কন্ট্রোল) এবং মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুধু প্রথম দিন নয়, এখন পর্যন্ত যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন কাউকে সিভিয়ার অসুস্থ্যতার কারণে কাউকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এমন কোন তথ্য পাইনি আমরা। জ্বর, ব্যথার যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা দুই একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। দুর্বলতা তিন চার দিন থাকছে। তবে এর ফলে অফিস বা স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হচ্ছেনা। এ সময় বিশ্রাম ও ফলমূল খেতে হবে।
সোমবার দ্বিতীয় চালানের ভ্যাকসিন আসার কথা রয়েছে
ভারতের সিরাম ইনষ্টিটিউট থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় চালানের ২০-৩০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ২২ ফেব্রুয়ারি আসবে বলে ১৫ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম জানান, সোমবার ভারত থেকে আরো ২০ ডোজ ভ্যাকসিনের একটি চালান বাংলাদেশে আসবে।
ভারতের উপহারের ২০ লাখ ও বেক্সিমকোর মাধ্যমে কেনা ৫০ লাখ ডোজ সহ মোট ৭০ লাখ ডোজ নিয়ে ভ্যাকসিনেশন শুরু করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুসারে সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসার কথা রয়েছে।