প্রণোদনার পেঁয়াজে কৃষকের ক্ষতি কোটি টাকা
বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে ১৫০ জন কৃষকদের প্রণোদনার পেঁয়াজের বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে বিনামূল্যের এই বীজে গজায়নি চারা। কৃষকদের অভিযোগ, তাদেরকে নিম্নমানের বীজ দেওয়া হয়েছে। এতে বগুড়ার এক উপজেলাতেই কোটি টার উপরে ক্ষতি হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকারও করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, 'পেঁয়াজের বীজের মান ভালো ছিল। অতিরিক্ত শীতে পর্যাপ্ত তাপমাত্রা না পাওয়ায় এই সঙ্কট হয়তো দেখা দিয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার মতো এখন আমাদের কিছু করার নেই।'
সারিয়াকান্দি বাদে অন্য কয়েকটি উপজেলায় প্রণোদনার বীজে আংশিক চারা গজালেও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, 'তাতে তেমন সমস্যা হয়নি।'
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে দুই দফায় প্রণোদনা হিসেবে পেঁয়াজের বীজ দেওয়া হয়। প্রথম দফায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ২৫০ গ্রাম বীজ সরবরাহ করা হয়। পরের ধাপে ডিসেম্বরের শেষ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হয় ৭৫০ গ্রাম করে।
এর মধ্যে দুই ধাপ মিলিয়ে বগুড়া সদর উপজেলায় দেওয়া হয় ১২০, শাজাহানপুরে ১০০, শেরপুরে ১৬০, ধুনটে ১৭০, গাবতলীতে ১১০, সোনাতলায় ২৩০, শিবগঞ্জে ২০০, কাহালুতে ৯০, দুপচাচিয়ায়, আদমদীঘিতে, নন্দীগ্রামে ৯০ এবং সারিয়াকান্দিতে ৪৫০ জনকে পেঁয়াজের বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে প্রথম ধাপে পাওয়া বীজে কোনো সমস্যা হয়নি। দ্বিতীয় ধাপের বীজগুলো গজায়নি। তবে সমস্যা বেশি হয়েছে সারিয়াকান্দিতে। এই উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে ১৫০ জন কৃষককে দেওয়া বীজের কোনো চারাই ওঠেনি। আর সোনাতলায় দ্বিতীয় ধাপে দেওয়া ১৫০ জনের আংশিক চারা গজিয়েছে। যদিও সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা বাদে অন্য উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা বলছে, তাদের দেওয়া বীজে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কৃষকরা বলছেন ভিন্ন কথা।
সারিয়কান্দিতে প্রথম দফায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ২৫০ গ্রাম করে ৩০০ জন কৃষককে দেওয়া হয়। ওই বীজগুলো থেকে চারা গজিয়েছে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে গত ২০ ডিসেম্বরে ১৫০ জনকে দেওয়া পেঁয়াজের বীজে।
৭৫০ গ্রাম করে উপজেলার ১২ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১৫০ জন কৃষকের প্রত্যেককে ৭৫০ গ্রাম করে বীজ দেওয়া হয়। এরসঙ্গে আরও দেওয়া হয় ২০ কেজি ড্যাপ ও ১০ কেজি এমওপি সার। এই ধাপে দেওয়া পেঁয়াজের বীজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষীরা।
সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পেঁয়াজের মৌসুম। কৃষি কার্যালয় বলছে, ৭৫০ গ্রাম পেঁয়াজের বীজ সাধারণত এক বিঘা জমিতে বপন করা হয়। এ হিসেবে শুধু সারিয়াকান্দিতে দ্বিতীয় ধাপে ১৫০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ বপন করেন কৃষকেরা। এ বীজ জমিতে ঠিকমতো বপণ করা হলেও কোনো কৃষকের জমিতে গজায়নি চারা।
পেঁয়াজ চাষীরা বলছেন, তারা কাজলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ সরকারের মাধ্যমে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রত্যেকে ৭৫০ গ্রাম করে বীজ পান।
কাজলা ইউনিয়নের কটাপুর গ্রামের চাষী মতিন খাঁ বলেন, 'আমাদের পাশের জমিতে চাষীরা বাজার থেকে বীজ কিনে বপন করছেন। সেই বীজগুলো জমিতে গজিয়ে তরতর করে পেঁয়াজের গাছ বেড়ে উঠছে। আমরা ভেবেছিলাম সরকারি বীজে ভালো ফলন পাব। কিন্তু ফলন তো দূরের কথা, কোনো বীজই গজায়নি।'
এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা বপন করেছিলেন কৃষক ইব্রাহিম শেখ। তিনি আরও বলেন, 'এখন আমাদের জমিগুলো পতিত হয়ে পড়ে আছে। অন্য কোনো ফসল করার সময় এখন আর নেই। আমরা গরিব কৃষক বর্গা জমি নিয়ে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। এখন এঅবস্থায় আমরা কী করব, ভেবে কোনো কুলকিনারা পাচ্ছি না। অথচ গত বছর একই পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজের চাষ করে ৭৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছিলাম।'
অন্য বছরে প্রতি বিঘা জমি থেকে গড়ে ৭০ হাজার টাকার পেঁয়াজ বিক্রি করেন তারা। এবার সেই হিসাবের খাতা একেবারেই ফাঁকা। অর্থাৎ পেঁয়াজের বীজে চারা না গজানোয় শুধু সারিয়াকান্দিতেই ১৫০ জন কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
কাজলা ইউনিয়নের পাকেরদহ গ্রামের কৃষক ধনু মণ্ডল বলেন, 'জমিতে এখন পেঁয়াজের কোনো চারাই নেই। খারাপ বীজ ছিল। সরকারি বীজের কারণে আমার ৮০ হাজার টাকা লোকসান হলো। সরকারি বীজ ভালো মনে করে নিয়েছিলাম। এখন ক্ষতিপূরণ কে দেবে?'
কাজলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ সরকার বলেন, 'ওরা চরের গরিব অসহায় চাষী। আমার নিজের ১০ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু বীজের মান ভালো না থাকায় তা গজায়নি। এখন তারা হা-হুতাশ করছেন।'
সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের উত্তর টেংড়াকুড়া গ্রামের চাষী ইব্রাহিম মিয়া বলেন, 'গত বছর এক বিঘা জমিতে ৫০ মন পেঁয়াজ হয়েছিল। ২ হাজার টাকা মন বিক্রি করেছিলাম। এবার প্রণোদনার বীজে আমাদের একদম নিঃস্ব করে দিল। জমি এখন পতিত হয়ে আছে। চৈত্র মাসে পাট চাষ ছাড়া কোনো আবাদ আর হবে না ওই জমিতে।'
এই বীজগুলো সারিয়াকান্দি একতা এন্টারপ্রাইজের মালিক স্বাধীনুর ইসলামের (বীজের ডিলার) কাছ থেকে নেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, 'বগুড়া সম্রাট বীজ ভাণ্ডার থেকে ভালো বীজ কিনে দিয়েছি। কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কীভাবে চাষীদের কাছে এমন হলো, আমার জানা নেই।'
সারিয়াকান্দি উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কুদরুত-ই-খুদা বলেন, 'আমরা গাজীপুর কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, পেঁয়াজের বীজ বপনের পর জমিতে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকার দরকার ছিল। এ মৌসুমে সেখানে ৬ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠা-নামা করায় পেঁয়াজের বীজ ভালো গজায়নি।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, 'পেঁয়াজের বীজের মান ভালো ছিল। তাছাড়াও এই সমস্যা তো শুধু আমাদের এখানে নয়। খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পেরেছি, চলতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ সমস্যা হয়েছে। এ এলাকার কৃষকরা দেরিতে পেঁয়াজ বীজ বপন করার কারণে ঠিকমতো চারা গজায়নি।'
সমস্যা সোনাতলা উপজেলাও হয়েছে। সোনাতলা পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, 'এবার প্রণোদনার বীজ ১৫ শতক জমিতে বপন করেছিলাম। চারা না গজানোয় কিছুদিন পরে সেই জমিতে ধান চাষ করেছি।'
সোয়া বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষবাদ করেছেন সোনাতলার খাবুলিয়া গ্রামরে চাষী মনোয়ার ইসলাম রুকু। তিনি বলেন, 'এবার পেঁয়াজের চারা ম্যার গেছে (আংশিক হয়েছে)। এই কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে পুরোপুরি ক্ষতি হয়নি।'
সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদ বলেন, 'চারা পুরোপুরি গজায়নি- বিষয়টি এমন নয়; কম গজিয়েছে। তবে জানুয়ারি মাসে বেশি শীতের মধ্যে বীজ দেওয়ার কারণে সংকট হয়েছে। অক্টোবরের দিক থেকে প্রণোদনার এই বীজ দিলে সমস্যা হতো না।'
শাজাহানপুরের শাহনগর এলাকার চাষী মোফাজ্জল হোসেন আরও একই গ্রামের চাষী দুলাল হোসেন মিলে ৭৫০ গ্রাম পেঁয়াজের বীজ পান। মোফাজ্জল জানান, তিনি পৌনে চার'শ গ্রাম পেঁয়াজের বীজ পেয়েছেন। তার জমিতেও আংশিক জড়িয়েছে চারা। তার হিসাবে এবার ৬০ ভাগ বীজ গজিয়েছে। শুধু এই বীজই নয়, বাজার থেকে কেনা বীজেরও চারা পুরোপুরি গজায়নি।
শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরে আলম বলেন, 'আমার উপজেলায় বেশি সমস্যা হয়নি। তবে শীতের কারণে হালকা সমস্যা হয়েছে। সেটা কৃষকদের বেশি ক্ষতি করবে না।'
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. দুলাল হোসেন বলেন, 'শীতের কারণে সমস্যা হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। এতে কৃষককেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখানে আমাদের কী বলার আছে! তবে অন্য প্রণোদনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।'