‘কুমির ভাই’
মুশতাক আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডেও যান। কৃষি খামারের প্রতি আগ্রহী হয়ে বিদেশে ঘুরে বেড়ান। চাকরি সূত্রে সুন্দরবন থেকে শুরু করে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরেছেন। চা বাগানেও ছিলেন কিছুদিন। আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও কাজ করেছেন। কিন্তু কোথাও তিনি মন বসাতে পারেন নাই। অদ্ভূতভাবে কুমির নামে এক হিংস্র প্রাণী নিয়ে মেতে গেলেন তিনি। মানুষ তাকে রীতিমতো পাগল বলা শুরু করল। কুমির কি চাষ করার জিনিস! কিন্তু মুশতাক ছিলেন অন্য এক কিসিমের মানুষ। নতুন কিছুই করতে চান তিনি। অন্যকে তিনি অনুসরণ করবেন না, অন্যরাই তাকে অনুসরণ করবে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে তিনিই প্রথম কুমির চাষ করা শুরু করেন। মিডিয়ায় পরিচিত হয়েছিলেন 'কুমির ভাই' বলে। দেশ থেকে প্রথম কুমির রপ্তানি করেন এই মুশতাকই।
তিনি বলেছিলেন, 'আমি যে পাগল ছিলাম না, তা প্রমাণ করতেই লেগেছে আট বছর।' দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে ৬৭টি কুমির রপ্তানির মাধ্যমে পরে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হন যে তিনি পাগল ছিলেন না। অথচ কুমির চাষের অনুমতি পেতে দুই বছরে ৩২টি টেবিল ঘুরে আসতে হয়েছিল তাকে। শুনতে হয়েছিল, দেশের বাইরে টাকা পাচারের ধান্ধা এসব। বুঝেন এবার, বিদেশে টাকা পাচার রোধে কী দায়িত্বশীল 'উনারা'!
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, বিসিএস, জব প্রিপারেশনের গাইডগুলাতে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে মুখস্ত করে, দেশের প্রথম কুমির চাষ হয়, ময়মনসিংহের ভালুকায়। হ্যাঁ, এটাই মুশতাকের সেই কুমিরের খামার ছিল। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেই খামার পরে অন্যকে হস্তান্তর করেছিলেন যদিও। রীতিমতো ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে সেই খামার৷ সেটাকে ব্যবহার করে পি কে হালদারদের মতো 'ইতিহাসশ্রেষ্ঠ লুটেরারা' কোটি কোটি টাকা পাচার করে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। কী দুর্ভাগ্য, একজন দেশপাগল মানুষের!
সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করা এ দেশের তরুণরা জানে না, বাংলাদেশের পথিকৃৎ একজন উদ্যোক্তার নাম। জানে না, তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সেই খামারে কয়েক হাজার কুমির ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। করোনাকালে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় অন্য অনেকের মতো সরকারের সমালোচনা করেছিলেন তিনিও, কার্টুনিস্ট কিশোরের কার্টুন শেয়ার দিয়েছিলেন। এর জন্য মুশতাক, কিশোরসহ আরও কয়েকজনকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ডিজেটাল আইন নামক 'কালাকানুনে' গ্রেপ্তার করা হয়৷ মাসের পর মাস জেলে বন্দী থেকে, জামিন না পেয়ে, নির্যাতনের শিকার হয়ে কাল তিনি জেলেই মারা গেলেন। এটা কি একটা হত্যাকাণ্ড নয়! একদিন আগেও জামিনের আবেদন করে জামিন পাননি মুশতাক, তাইলে হয়ত বেঁচে যেতেন তিনি।
কুমির চাষে নামার আগে সুন্দরবন এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে অন্যজনের সূত্রে পরিচয় হয়েছিল মাসিহা আখতার লিপার সাথে, তাকেই বিয়ে করেছিলেন তিনি। লিপা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্রী, গবেষণা করেছিলেন মুক্তা চাষ ও ইলিশ নিয়ে। রীতিমতো 'কুমির চাষের এনসাইক্লোপিডিয়া' ছিলেন তিনি। এ জন্যই হয়ত আরেক কুমির পাগল মুশতাকের প্রেমে পড়েছিলেন। স্বামী জেলে যাওয়ার পর যে ধাক্কা সইতে হলো তাকে, তার ট্রমায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি-- যাকে বলে মানসিক রোগী। স্ত্রীর এ অবস্থা জানার পরেও, মা বাবার একমাত্র ছেলে ও ভরনপোষণকারী হওয়া সত্ত্বেও মাসের পর মাস মুশতাককে জামিন দেওয়া হয়নি। শেষমেশ জেল থেকে হাতকড়া ও দান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় তার লাশটা বের হলো! জলের হিংস্র কুমিরকে বশ মানালেও 'ডাঙার কুমির' রেহাই দিল না।
যে স্বপ্নবাজ দম্পতি এ দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, দেশে নতুন একটি রপ্তানিমুখী খামারের জন্ম দিয়েছিলেন, বিদেশে গিয়ে সুখে থাকার বদলে দেশকেই বেছে নিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে দেশকে নতুন কিছু দিতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন, তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করেছিলেন সেই মুশতাক আর লিপাকে তিলেতিলে শেষ করে দেয়া হইল; অনিয়ম-অনাচার-অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা করায়, একজন নাগরিক হিসেবে নিজের মত প্রকাশ করায়-যেটা তার অধিকার! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসে এটাই এখন আজকের বাংলাদেশ আর আমরা তার 'গর্বিত' নাগরিক।
হেন কোনো অপরাধী নাই, এ দেশে জামিন পায় না। এমনকি একই মামলায় গ্রেপ্তার অন্যদেরও জামিন দেওয়া হয়েছে। আর 'ভিত্তিহীন, 'হাস্যকর', 'শিশুসুলভ' কিছু অভিযোগে আটকে রাখা হয় মুশতাক আর কিশোরকে। জীবিত মুশতাক জামিন না পেলেও চিরতরে মুক্তি পেয়ে গেছে তার লাশ। অন্যদিকে, জেলখানায় মরতে বসেছেন কার্টুনিস্ট কিশোর। তারও শারীরিক অবস্থা খারাপ বলে পরিবার জানাচ্ছে। তাকেও অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে এই 'কালাকানুন' বাতিল করা হোক। কথা বলার জন্য, লেখার জন্য, আঁকার জন্য কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার, রিমান্ড, নির্যাতনের আইন কোনোভাবেই থাকতে পারে না 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' পাওয়া এই বাংলাদেশে, কোনোভাবেই না।
- রাফসান গালিব: সাংবাদিক, অনুবাদক ও লেখক
- ইমেইল: [email protected]