জনসন অ্যান্ড জনসন: যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় ভ্যাকসিন যেখানে অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা
তৃতীয় আরেকটি করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ যাত্রায় তারা পাবে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির বানানো ভ্যাকসিন।
ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইতোমধ্যেই জরুরি প্রয়োজনে এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়াও সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের সুপারিশ পেয়েছে তারা। ফেডারেল সরকারও তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যাকসিনটি বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে বন্টনকৃত মডার্না ও ফাইজার ভ্যাকসিনের চেয়ে জনসন অ্যান্ড জনসনের জেনসেন ভ্যাকসিন খানিকটা আলাদা। চলুন, সেই কারণগুলোই জানা যাক এবার:
একটিমাত্র ডোজ
জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনের একটি বড় সুবিধা হলো এটির একটিমাত্র ডোজই আপনার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ করোনা ভ্যাকসিনের জন্য আপনাকে বারবার ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হবে না কিংবা পরবর্তী ডোজ রোগী নিলেন কি না অথবা ঠিক সেই মুহূর্তে ডোজ সহজলভ্য কি না, সে চিন্তায় থাকতে হবে না চিকিৎসকদেরও।
অন্যদিকে, ফাইজার ও মডার্না ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আপনাকে দুবার ডোজ নিতেই হবে। ফাইজার প্রথমটি নেওয়ার তিন সপ্তাহ এবং মডার্নার দ্বিতীয় ডোজ চার সপ্তাহ পর নেওয়ার নিয়ম থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন ভাবছে বিকল্প পন্থার কথা। আর সেটি হলো, দ্বিতীয় ডোজের সময়কাল বাড়ানো যায় কি না, যেন আরও বেশি মানুষ প্রথম ডোজটি পেতে পারে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, সেক্ষেত্রে সুরক্ষাও কমই পাবে জনগণ।
অথচ জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনের একটিমাত্র ডোজই তার সম্পূর্ণ সুরক্ষার প্রমাণ দিতে পেরেছে।
আলাদা কার্যক্ষমতা
ফাইজার ও মডার্নার তুলনায় জনসন অ্যান্ড জনসন কতটা কার্যকারিতা দেখাতে পারল, তা হয়তো সাধারণ মানুষ লক্ষ্য করেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রথম দুটি ভ্যাকসিনই ৯৪ থেকে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলে কোভিড রোগীদের কেস প্রমাণ দেয়, ভ্যাকসিন দুটি আসলেই নিজেদের কার্যকারিতা ধরে রেখেছে। ইসরায়েলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার পর দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া লোকের মধ্যে করোনার উপসর্গ কমে ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে, সাধারণ অসুস্থতায় জেনসেন ভ্যাকসিনের সার্বিক কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৬৬ শতাংশ। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতায় এটির কার্যকারিতা ৮৮ শতাংশ এবং ট্রায়ালে এটি ১০০ শতাংশ মৃত্যু প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখিয়েছে। জেনসেন ভ্যাকসিন নেওয়া কেউই এখনো পর্যন্ত করোনায় মারা যায়নি।
জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে একটি বড়সংখ্যক আলাদা স্থান ও মানুষের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় ৪৪ হাজার মানুষের মধ্যে এই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। ফাইজারের ভ্যাকসিনও ৪৩ হাজার মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয় ফাইজার ও মডার্নার বেশ কয়েক মাস পরে।
মূলত কোভিডের কিছু নতুন উপসর্গ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে জনসনের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। বি.১.৩৫১ (B.1.351) নামে একটি নতুন উপসর্গ প্রথম দেখা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাতে। এই উপসর্গ এতটাই শক্তিশালী, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও তা শরীরের ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই উপসর্গের বিরুদ্ধে জনসনের ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে এই উপসর্গের প্রকোপ কম থাকায় সেখানে ছিল তা ৭২ শতাংশ।
ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা যদিও বলছেন, সবগুলো ভ্যাকসিনই সবচেয়ে জটিল সময়ে বেশ ভালো সুরক্ষা দেবে, কিন্তু নানা স্থানে নানা কার্যকারিতার ধরনের ফলে এমনটা হওয়া সম্ভব- লোকে জনসনের ভ্যাকসিনকে দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে রাখবে।
দ্রুত সুরক্ষা
জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন শরীরে নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর থেকেই কাজ করতে শুরু করবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডেটা থেকে জানা গেছে, চার সপ্তাহ পার হবার পর কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তির কিংবা মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, ফাইজার ও মডার্নার ক্ষেত্রে দুই ডোজ নিতে হয় পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষার জন্য এবং তাতে প্রথম ডোজের পর অন্তত ৫-৬ সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার
মডার্না ও ফাইজার তাদের ভ্যাকসিনে 'মেসেঞ্জার আরএনএ' (mRNA) নামে একটি ব্র্যান্ড নিউ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এটি ফ্যাটি এসিডের মধ্যে এ ধরনের জেনেটিক কোড সরাসরি ঢুকিয়ে দেয়, যা পরে আর্ম মাসল সেলের মধ্যে ঢুকে একটি ইমিউন সিস্টেম তৈরি করে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।
কিন্তু জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন ব্যবহার করে ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি। এটি অ্যাডেনোভাইরাস ২৬ নামে একটি সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত ভাইরাস জেনেটিক্যালি ঢুকিয়ে দেয়, তবে তা মানুষকে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত করে না। ছোট লিপিড বল বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এটি আর্ম সেলের মধ্যকার দুর্বল ভাইরাসের মধ্যে জেনেটিক ইনস্ট্রাকশন দেয়। তারপর স্পাইক প্রোটিন স্ফীত আকৃতি ধারণ করে সেলগুলোকে সংযুক্ত করে দেয়।
সহজে সামলানো
মডার্না ও ফাইজার ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত নরম ছোট্ট ফ্যাট বলগুলোকে সর্বোচ্চ সাবধানতার সঙ্গে সামলাতে হয়। এছাড়াও ফাইজার ভ্যাকসিন অবশ্যই মাইনাস ৮০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ১১২ থেকে মাইনাস ৭৬ ফারেনহাইট) তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন বিশেষ ফ্রিজার। তাও এই ভ্যাকসিন ফ্রিজে রাখা যায় মাত্র পাঁচ দিন এবং দ্রব ও মিশ্রিত (ডাইলুটেড) হবার ছয় ঘণ্টার মধ্যেই ব্যবহার করতে হয়।
ফাইজার ভ্যাকসিন কোনোভাবেই ব্যবহারের আগে ঝাঁকানো যাবে না এবং অবশ্যই ডাইলুট করে নিতে হবে। মডার্নাতেও রয়েছে প্রায় সমপরিমাণ ঝক্কি। কিন্তু জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই তিন মাস পর্যন্ত রাখা যাবে, যা এর ব্যবহারকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে।
তবে তিনটি ভ্যাকসিনের মধ্যেই কিছু কমন বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এদের কোনোটির মধ্যেই এমন কোনো যোজনীয় দেওয়া হয়নি, যা শরীরের মারাত্মক কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এই ভ্যাকসিনগুলো নেওয়ার পর এলার্জিক রিঅ্যাকশন হবার আশঙ্কাও খুবই কম। বিশেষ করে জীবন ঝুঁকিতে ফেলার মতো অ্যানাফাইলেক্সিস হবার ঝুঁকিও কম। জনসনের ভ্যাকসিন নেওয়া ৪৪ হাজার ব্যক্তির মধ্যে মাত্র একজন অ্যানাফাইলেক্সিসের কেস পাওয়া গেছে।
তিনটি ভ্যাকসিনই স্পাইক প্রোটিন নামে একটি টার্গেট পূরণ করতে পেরেছে। এই বিশেষ প্রোটিনের মিউটেশন বা পরিবর্তন তাদের কার্যক্ষমতাকেই দুর্বল করে দিতে পারে।
-
সূত্র: সিএনএন