বাণিজ্যিক মধু চাষ: লাভবান চাষি, বাড়ছে ফসলের উৎপাদনও
শরীয়তপুরে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে খামারের সংখ্যা। তেল ও মসলা জাতীয় ফসল জমির পাশে গড়ে ওঠা এসব মৌখামার কৃষির জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদ। মৌমাছির পরাগয়নের ফলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ে কালোজিরা, ধনিয়া আর সরিষার।
বাণিজ্যিক এ মধুর স্বাধ, গন্ধ, রঙ, এক কথায় গুণগতমান ভালো হওয়ায় রপ্তানি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারেও।
এ বছর শরীয়তপুরে ৭৮টি ভ্রাম্যমান মৌচাষির দল এসেছে। তারা শুধু স্বাবলম্বীই হচ্ছেন না, অবদান রাখছেন অর্থনীতিতেও। মৌখামারকে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছে অনেক বেকার যুবকের।
শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত বছরের চেয়ে এ বছর এ জেলায় ২৯টি খামার বেড়েছে; এর ফলে ৪৮২০টি মৌবাক্স বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে ৪৯টি খামারে মৌবাক্স ছিল ৭ হাজার ৭৬০টি, সেখানে ২০২১ সালে ৭৮টি খামারের ১২ হাজার ৫৮০টি মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে।
গত বছর এসব মৌখামার থেকে ৪২ টন মধু সংগ্রহ হয়েছে। এ বছর ৮০ টন মধু সংগ্রহ হবে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ।
প্রতিটি মৌবাক্স থেকে কমপক্ষে তিনবার মধু সংগ্রহ করা যায়। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি- এই তিন মাস মৌচাষিরা মধু সংগ্রহের জন্য শরীয়তপুরে অবস্থান করেন। এ সময় তারা সরিষা, ধনিয়া ও কালোজিরার ফসল থেকে মধু সংগ্রহ করে ফিরে যান লিচু ফুলের মধু সংগ্রহের জন্য।
তেল ও মসলা জাতীয় এসব ফসলি মাঠের পাশে অস্থায়ীভাবে অবস্থান নেন মৌচাষিরা। ক্ষেতের পাশে বসিয়ে দেন সারি সারি মৌবাক্স। প্রতিটি বাক্সে একটি করে রানি মৌমাছিসহ কয়েক হাজার কর্মী মৌমাছি থাকে। তারা ছুটে যায় ফসলি মাঠে। ফুল থেকে আহরণ করে ফুলের নেক্টার।
মৌমাছির দল সেই নির্যাস বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘণ মধুতে রুপান্তরিত হয়।
মৌচাষিরা ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর বাক্সের ভেতর থেকে নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে মধু সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত মধু হাতের স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ মেশিনের সাহায্যে বের করে আনা হয়। এরপর তা মজুদ রাখা হয় বিভিন্ন আকারের কনটেইনারে।
মধু ক্রয়ে মৌচাষির কাছে আসেন ক্রেতারা। দর দাম করে মধু কিনে নিয়ে যান তারা।
ইভা মৌখামারের স্বত্বাধিকারি জাহিদ হাসান বলেন, 'এ বছর করোনার কারণে মধুর চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। মানুষ এখন নিয়মিত মধু খাচ্ছে। বেচাবিক্রি অনেক ভালো। সরিষার মধুর কেজি ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, এবার তা বিক্রি করেছি ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। ধনিয়ার মধু কেজি ছিল ৪০০ টাকা; এবার বিক্রি করছি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। কালোজিরার মধু ৪৫০ ছিল; এখন তা ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এ সবই পাইকারি দর। খুচরা বাজারে আমরা এসব মধু কমপক্ষে ২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি দেশে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করতাম। এখন নিজেই বিদেশে যোগাযোগ করেছি। মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশ কাতার, দুবাই ও সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে অনলাইনে মধু বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।'
'মৌমাছি মধু' নামে রাজশাহীর একটি কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী সামিউল মিকদাদ জানান, তিনি প্রতি বছর মুধ কিনতে শরীয়তপুরে আসেন। এ অঞ্চলের ধনিয়া ও কালোজিরার মধু বেশ সমাদৃত। গুণগত মানও ভালো।
'প্রতি বছর আমি এ অঞ্চল থেকে ৫ থেকে ৬ টন মধু কিনি। এরপর মধুতে থাকা ময়েশ্চার বা অতিরিক্ত পানি অটো প্রসেসিং প্লান্টের সাহায্যে কমিয়ে বোতলজাত করে বাজারের বিক্রি করি। সৌদি আরবের আলশিফা এবং ভারতের ডাবর কোম্পানিও বাংলাদেশ থেকে মধু কিনে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের এপি অনেক মধু কেনে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মধুর গ্রেড ১৮ দশমিক ৬ নির্ধারণ করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
সামিউল আরও জানান, এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে মধুর চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় দামও অনেক বেশি।
জাজিরা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জামাল হোসেন বলেন, 'এক সময় কৃষক মৌচাষিদের জমির পাশে বসতে দিত না। তাদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, ফসলের উৎপাদন কমে যাবে। কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টায় কৃষকদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, ফসলের উৎপাদন কমে না, বরং বৃদ্ধি পায়। এখন কৃষক নিজেই তার প্রমাণ পেয়েছেন। আগের তুলনায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত ফসল বেশি পাচ্ছেন। ফলে একদিকে মৌচাষ দিন দিন বাড়ছে, অন্যদিকে মসলা ও তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাব দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।'
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ পারভেজ হাসান বলেন, 'শরীয়তপুরে বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদনের একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরিষা, ধনিয়া আর কালোজিরার ব্যাপক চাষাবাদের কারণে মৌচাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার মধু ভিন্ন গুরুত্ববহন করে, কারণ কালোজিরার মধুর ওষুধি গুণ প্রমাণিত।'
'এ জেলার উৎপাদিত মধু সারা দেশ ও বহির্বিশ্বে ছড়িতে দিতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উদ্যোক্তরা শরীয়তপুরে এসে মধু কিনে নিয়ে যাবে এবং তাদের ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ পৃথিবী অন্য দেশেও ছড়াবে। এতে শরীয়তপুরের মধুর পরিচিত বাড়বে, আরও সম্প্রসারণ হবে, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন, মোদ্দাকথা কৃষি অর্থনীতি এগিয়ে যাবে,' বলেন জেলা প্রশাসক।