যেকারণে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা মহামারি ঠেকানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে
মহামারির প্রথম বছরটি আমার কেটেছে পরিচিতজনদের চাইতেও খারাপভাবে। পরিচিতজনদের চাইতে আমার জীবন কঠিন হয়ে পড়েছিল তেমন কারণ অবশ্য ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা; নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমার পরিবার ছিল মহামারির অভিঘাত থেকে সুরক্ষিত। তারপরও দুঃসহ একটি বছর পার করার কারণ ছিল মানসিক অশান্তি। সত্যি বলতে কী- মানসিক শক্তি হারিয়ে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম ভেতরে ভেতরে।
স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থাকার সময় আমার বন্ধু ও স্বজনেরা অনেক রকম দক্ষতা অর্জন করেন, আবিষ্কার করেন সময় কাটানোর নিত্যনতুন শখ। আমি এতোটা সবল ও কর্মঠ ছিলাম না। বরং ডুবেছিলাম জীবনের পাওয়া- না পাওয়া নিয়ে পাগলের মতো বিলাপে। ভেবেছিলাম এবার বুঝি সবশেষ, না পাওয়ার বোঝা নিয়েই বুঝি পৃথিবী থেকে আমায় সরিয়ে দেবে এ মহামারি। পরিচিতদের তুলনায় আমি খুব কমই হারিয়েছে- সেকথা ভালোই জানতাম। তাই এতোটা বিপর্যস্ত সময় কাটানোর জন্য এখন বেশ লজ্জাই পাই।
তবে এতসব কথা বলার কারণ- হতাশার জাল ছিন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম তখন। তাই গেল বছর আমি বেশকিছু ভ্যাকসিন ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেওয়ার আবেদন করতে থাকি এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার সুযোগও পেয়ে যাই। সিঙ্গেল ডোজের ওই টিকা গবেষণায় অতি-সামান্যতম অবদান রাখতে পেরেছি- এটা জানাও ছিল আমার জন্য স্বস্তির কারণ। তবে অস্বীকার করব না আমার মূল লক্ষ্য ছিল; স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রতিষেধক পেয়ে রোগ প্রতিরোধ অর্জনের সুযোগ। সেই সম্ভাবনার কাছে ট্রায়ালের ঝুঁকি নগন্য হয়ে ওঠে।
এরপর গেল ডিসেম্বরে আমাকে ডোজ ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। তখন উত্তেজনায় প্রায় শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম। অবশ্য, সে দশা স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। পরদিনই শরীরে টিকাগ্রহণের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না দেখে নিশ্চিত বুঝতে পারলাম আমাকে প্লেসেবো দেওয়া হয়েছে। এই প্লেসেবো হলো ট্রায়ালে মূল প্রতিষেধকের সঙ্গে ব্যবহৃত এক ধরনের নির্যাস। স্বেচ্ছাসেবীদের দুই অংশে ভাগ করে তাদের একদলকে মূল প্রতিষেধক দেওয়া হয়, আরেকদল পান প্লেসেবো।
তারপর অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে জরুরী প্রয়োগের অনুমোদন পায় জনসন অ্যান্ড জনসনের সিঙ্গেল ডোজ ভ্যাকসিন। মডার্না এবং ফাইজার ভ্যাকসিনের মতোই এটিও কোভিড-১৯ এ গুরুতর অসুস্থ হওয়া এবং মৃত্যু ঠেকাতে সক্ষম। তবে জনসন অ্যান্ড জনসনের ট্রায়ালের তথ্যে কার্যকারিতার হার ছিল প্রথমোক্ত দুটি ডাবল ডোজ ভ্যাকসিনের তুলনায় কম। এরফলে অনেকেই ধারণা করেন, হয়তো এটি ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিনের তুলনায় দুর্বল মানের সুরক্ষা তৈরি করে।
মানবদেহে ট্রায়ালে ফাইজার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছিল ৯৫ শতাংশ। মডের্নার ছিল ৯৪ শতাংশের কিছু বেশি। জনসন অ্যান্ড জনসন কিন্তু কিছুটা ভিন্নভাবে তাদের প্রতিষেধকের কার্যকারিতা যাচাই করেছে। ট্রায়ালে মারাত্মক অসুস্থতা ঠেকাতে তাদের টিকাটি ৮৫ শতাংশ সফল প্রমাণিত হয়। মাঝারি ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে এই হার ৬৬ শতাংশ। মার্কিন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনুমোদিত যেকোনো একটি টিকা নেওয়ার জন্য সকলের প্রতি পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু, জনগণ নিশ্চিতভাবেই জানেন সবগুলো টিকা এক রকম নয়।
অর্থাৎ, কোনোটিতে ভ্যাকসিনে আস্থা আছে অন্যটির তুলনায় বেশি। এই যেমন জনসন ভ্যাকসিনের চালান নিতে প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করেন ডেট্রোয়েটের মেয়র। তিনি বলেন, আমার শহরবাসী সেরা ভ্যাকসিনটি পেতে চায়। পরে অবশ্য তিনি মত বদলান।
তবে এই ঘটনায় জনমনে একক ডোজের টিকা ঘিরে সন্দেহ স্পষ্ট হয়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় গেল ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সরকারের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র- সিডিসি পরিচালিত এক জরিপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৮ শতাংশ নাগরিক দুই ডোজের টিকা নেওয়ার পক্ষে মত দেন। যার বিপরীতে এক ডোজের টিকা নিতে চান মাত্র ৭ শতাংশ। তবে দুই ডোজের পক্ষে মত দেওয়া ৫৮ শতাংশের মধ্যে এক-চতুর্থাংশের কিছু বেশি অংশগ্রহণকারী একমাস অপেক্ষা করে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার চাইতে; এই মুহূর্তেই একক ডোজের টিকা নেওয়ার পক্ষে মত দেন।
ভ্যাকসিন ট্রায়ালের সুবাদে আগেভাগে টিকা নেওয়াড় সে সুযোগ আমিও পেয়েছিলাম। ট্রায়াল চলাকালে স্বেচ্ছাসেবীরা প্লেসেবো পেয়েছেন নাকি পরীক্ষাধীন প্রতিষেধক পেয়েছেন- তা জানতে পারেন না। তবে ট্রায়াল শেষ হওয়ার কারণে চলতি মাসে সেই তথ্য প্রকাশ করেন গবেষকরা। তখন আমার আগের ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়। আসলে আমি প্লেসেবো-ই পেয়েছিলাম। এরপর, গবেষকরা আমাকে আসল প্রতিষেধক নেওয়ার প্রস্তাব দেন। নিজ শহর নিউইয়র্কে কবে টিকা নেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হব- তা এখনও জানি না। তাই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। গবেষকদের কাছে অতিদ্রুত টিকাটি দেওয়ার অনুনয় করি। তারপর, গত সপ্তাহে টিকাটি পেয়েছি।
টিকা নিয়ে আমি উচ্ছসিত এবং কৃতজ্ঞ। তবে ডাবল ডোজ টিকার তুলনায় এটি কম কার্যকর কিনা- সেই সন্দেহ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তবে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের ডিন ডা. আশিষ ঝা আমাকে জনসন আবিষ্কৃত টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, "অন্য টিকার সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য থাকলেও- সেটি এত কম ও অপ্রাসঙ্গিক যে আমি অন্তত এনিয়ে চিন্তিত হব না।"
ফাইজারের ৯৫ শতাংশ সফলতা হারের সাথে জনসনের ৬৬ শতাংশ সফলতা আমার কাছে অবশ্য কম পার্থক্য বলে মনে হয়নি। কিন্তু, ডা. ঝা বোঝালেন, ভ্যাকসিন কোথায় এবং কখন ট্রায়াল চালানো হয়েছে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই সফলতা হারের তথ্য আসলে এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মহামারিতে জীবাণুর নতুন ও প্রাণঘাতী ধরনের উৎসস্থল দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে ট্রায়াল চায়াল জনসন। এসব দেশে নতুন যেসব ধরন সংক্রমণের প্রধান উৎস সেগুলো ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত টিকাগুলো, যেমন; অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না ও ফাইজারের টিকা খুব একটা প্রতিরোধ করতে পারে না। তাছাড়া অন্যান্য টিকার ট্রায়ালের পরে অনুষ্ঠিত হয় জনসনের ট্রায়াল- সেসময়ে সার্স কোভ-২ জীবাণুর অধিক প্রাণঘাতী আরও বেশি ধরন তৈরি হয়। তারপরও, ট্রায়ালে অংশ নিয়ে প্রতিষেধক পাওয়া স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা কোনো মৃত্যুর ঘটনা লক্ষ্য করা যায়নি। নিঃসন্দেহে এই অর্জন বিশাল। ঝা বলেন, "আপনি যদি জানতে চান যে, দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ধরনটির ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো প্রমাণ কে দিয়েছে এবং কোন ভ্যাকসিন এর থেকে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা দেয়- তাহলে আমি জনসন ভ্যাকসিনের কথাই বলব।"
তবে ঝা আশা করেন যে, ফাইজার এবং মডার্নার টিকাও করোনাভাইরাসের অভিযোজিত নতুন ধরনগুলির বিরুদ্ধে কার্যকর হবে। জনসন ভ্যাকসিন সবার সেরা তিনি এমন দাবি করেন না। তবে প্রতিটি প্রতিষেধকের যে নিজস্ব সুবিধা আছে- সেদিকে আলোকপাত করেন।
- লেখক: ২০১৭ সাল থেকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে মতামত কলাম লেখক মিশেল গোল্ডবার্গ। রাজনীতি, ধর্ম এবং নারী অধিকার নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন তিনি। কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে ২০১৮ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার পাওয়া একটি টিমের সদস্য ছিলেন তিনি।