পুতিনের লক্ষ কোটি টাকার প্রাসাদের রহস্য
দুবাইয়ের স্বাভাবিক উষ্ণ আবহাওয়ায় নিজের ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন লাফ্রাঙ্কো চিরিল্লো। পরনে শর্টস ও পোলো শার্ট। কিছুক্ষণ পরই বেরোবেন সমুদ্র সৈকতের পাশে ড্রাইভ করতে।
কয়েক দশক ধরে মস্কোর অভিজাতদের জন্য চমৎকার চোখ ধাঁধানো সব ভিলা ও ইতালীয় নকশার বাড়ি-ঘর তৈরি করে দেওয়ার পর অবশেষে শীতল রাশিয়াকে বিদায় জানিয়েছিলেন প্রকৌশলী লাফ্রাঙ্কো চিরিল্লো। এমনকি মস্কোতে নিজের প্রকৌশল ফার্মটিও বন্ধ করে দিয়েছেন।
তবে রাশিয়ার মানুষ কিন্তু এখনো ভোলেনি চিরিল্লোর কাজের কথা। আর এজন্য বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনি এবং তার ইউটিউব ফিল্ম 'অ্যা প্যালেস ফর পুতিন'কে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কৃষ্ণসাগর উপকূলে তৈরি একটি বিলাসবহুল প্রাসাদই এই ইউটিউব সিনেমার মূল বিষয়।
নাভালনির দাবি, প্রাসাদটি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার বন্ধুবান্ধবের জন্য তৈরি।
ইউটিউবে ইতোমধ্যেই নাভালনির ফিল্মটি দেখা হয়েছে ১১৩ মিলিয়ন বার। জরিপ অনুযায়ী, এক-চতুর্থাংশ রাশিয়ান এটি দেখেছেন। আর এই প্রাসাদের নির্মাতা কে, জানেন? লাফ্রাঙ্কো চিরিল্লো।
তবে চিরিল্লো তার এই প্রজেক্টকে অভিহিত করলেন 'সমৃদ্ধ' নামে। তিনি যা ব্যাখ্যা দিলেন, তাতে মনে হতেই পারে, নিজেকে যেন খানিকটা দূরে রাখতে চাইছেন; প্রমাণ দিতে চাইছেন এই জমকালো প্রাসাদ নির্মাণ সম্পর্কে: 'স্থাপত্যের দিক থেকে বিচার করলে এটাই আমার বানানো সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট নয়। তবে এটি নিওক্লাসিসিজমের এক চমৎকার উদাহরণ। একজন প্রকৌশলী হিসেবে আমাকে যা ফরমায়েশ দেওয়া হয়, আমি সেরকমই বানাই। আর নান্দনিকতাবোধ বিচার করলে, এটি আসলে সবদিকেই সমান ভাগে সঠিক।'
'এটা শুধুমাত্র বাহ্যিক চাকচিক্যের মামুলি অর্থের কিছু নয়। এখানে কোনো বেশি আড়ম্বরও করা হয়নি। এটা সহজাত সুন্দর এক প্রাসাদ। আমরা দারুণ সব নির্মাণ সামগ্রী এখানে ব্যবহার করেছি এবং আমি আমার কাজ নিয়ে গর্বিত', বলেন চিরিল্লো।
এই স্থাপত্য সম্পর্কে 'রিচ' বা সমৃদ্ধ শব্দটি বোধহয় অনেক রাশিয়ানও ব্যবহার করবেন। নাভালনির ফিল্মে দেখানো হয়েছে, এখানে রয়েছে একটি পুল ডিস্কো, একটি সীসা বার, পোল ডান্সের জায়গা এবং হোম থিয়েটার। প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনার জায়গায় চিরিল্লোর আর্কিটেকচারাল ফার্ম 'স্ট্রয়গাকমপ্লেকট'-এর নামটিও দেখানো হয়েছে।
এদিকে, দুবাই থেকে চিরিল্লো ভিডিওকলে জানিয়েছেন, নাভালনির ফিল্মটি তিনি দেখেছেন। প্রাসাদের পরিকল্পনা যে তারই করা, সে কথা স্বীকার করে তিনি জানান, ফিল্মে দেখানো থ্রিডি রিকনস্ট্রাকশনের বিষয়টিও সঠিক। তবে চিরিল্লো আরও জানান, সীসা বারের পরিকল্পনা তিনি করলেও ভিডিওতে দেখানো পোল ডান্সের বিষয়টি বানোয়াট।
পুতিনের জন্য নয়, অন্য কারো জন্যেও নয়?
চিরিল্লোর ধারণা, নাভালনির ফিল্মে প্রাসাদের সব ব্যাপারই অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, কৃষ্ণ সাগরের পাশে অবস্থিত এই সম্পত্তি পুতিন কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য বানানো হয়নি।
চিরিল্লো জানান, এ ব্যাপারে এত হইচইয়ের কারণ বুঝতেই পারছেন না তিনি। তার মতে, ১২ বছর পুরনো একটা প্রাসাদ নিয়ে চিন্তা করা ছাড়াও রাশিয়ার আরও জটিল সব সমস্যা রয়েছে।
চিরিল্লোর কাছ থেকে কিছু তথ্য জানান গেলেও নিজের স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে তিনি কিছু প্রশ্নের উত্তর মানুষের কাছে অজানা রেখেছেন।
চিরিল্লো জানালেন, গল্পটার শুরু ২০০৭ কিংবা ২০০৮ সালে। প্রকৌশলী হিসেবে তখন বেশ ভালোই প্রতিপত্তি ছিল তার। মস্কোতে তিনি পা রাখেন ১৯৯০ সালের দিকে এবং তখন তিনি মাসকাগনি ফার্নিচার কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন। নিজেকে এক প্রকার লাইফস্টাইল শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তখন এবং রুশদের গ্রামীণ ভবন ও ভিলা তৈরি করতেন।
'তখনকার দিনে খুব কম বিদেশিই রুশ ভাষা জানত এবং তাদের চাহিদামাফিক পণ্য বানাতে পারত। আমরা যে শুধু ঘর বানিয়েছি, তা নয়; লাইফস্টাইল বিক্রি করেছিও বলা যায়,' গর্বভরে বলেন চিরিল্লো।
ফোর্বসের তালিকার ৪৪ জন রাশিয়ান বিলিওনিয়ারের নাম চিরিল্লো পেয়েছেন, যারা তার ক্লায়েন্ট ছিলেন। সেন্ট পিটার্সবুর্গ, লন্ডন, প্যারিস ও বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে তার এসব ক্লায়েন্ট ছিলেন। তবে চিরিল্লো জানালেন, তার বেশিরভাগ কাজই ছিল রুবলিয়োভকা এবং পশ্চিম মস্কোর ধনী আবাসিক এলাকায়।
রাশিয়ায় থাকাকালে পাগলাটে ধরনের সব অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছেন উল্লেখ করে চিরিল্লো বলেন, 'এর কারণ, রাশিয়ায় পাগলামির জন্যেই আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।' এর কিছু উদাহরণ না দিলেই নয়; যেমন- বিমানের ভেতরে পুরোপুরি স্বর্ণের বাথরুম, রিমোট কন্ট্রোল ওয়ার্ডরোব, প্রায় মুক্তার মতো দামি পাথরের বাথরুম কিংবা ১০০ মিটার লম্বা ইয়ট সাজানো ইত্যাদি পাগলামি তিনি দেখেছেন।
চিরিল্লো নিজের ফার্মে ১৪০ জন প্রকৌশলী এবং ইঞ্জিনিয়ার রেখেছিলেন এবং কোনো রকম ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন ছাড়াই মুখে মুখে কাজের অর্ডার নিতেন তারা। এমনি তাদের ওপর কাজের চাপ এত বেশি ছিল, তা 'ওভারবুকড' হয়ে যেত!
দৃশ্যপটে জর্ডানি ব্যবসায়ী
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে নিজের অতি ধনী ক্লায়েন্টদের বাইরে চিরিল্লোকে রাশিয়ার বা ইতালির প্রকৌশলী শ্রেণি খুব একটা চিনতই না। খ্যাতিমান রুশ আর্কিটেকচারাল ক্রিটিক গ্রিগরি রেজভিন বলেন, 'আমার চোখে চিরিল্লো শুধু একজন স্থপতিই নন, তিনি নামি-দামি ইতালীয় আসবাবপত্রের ডিলারও বটে।'
২০১০ সালের দিকে জনসম্মুখে চিরিল্লোর নাম প্রথম প্রচার হতে থাকে এবং ততদিনে তিনি সেই রহস্যময় কৃষ্ণসাগর প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত। তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের কাছে এক খোলা চিঠিতে একজন ব্যবসায়ী জানান গেলেনডজিক অঞ্চলে পুতিনের জন্য নির্মাণাধীন সেই সুরম্য প্রাসাদের কথা। সেই ব্যবসায়ী জানান, সেই প্রাসাদ প্রজেক্টের ব্যাপারে কীভাবে তিনি ও অন্যান্য ব্যবসায়ীকে ঠকানো হয়েছে। প্রজেক্টটির ইন্টেরিয়র নকশা যে পুতিনের নিজের অনুমোদনকৃত এবং চিরিল্লো তা বাস্তবায়ন করেন, সে কথাও চিঠিতে লিখতে ভোলেননি ওই ব্যবসায়ী।
তবে পুতিনের কথা জিজ্ঞেস করার আগেই চিরিল্লো জানিয়ে দিলেন, তিনি বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্টকে কখনোই গেলেনডজিক অঞ্চলে দেখেননি এবং এই প্রজেক্টের ব্যাপারে তার সঙ্গে কোনো কথাও হয়নি।
চিরিল্লোর দাবি, তার ক্লায়েন্ট ছিল জর্ডানি ব্যবসায়ী জিয়াদ আল মানাসিরের মালিকানাধীন কোম্পানি স্ট্রয়গাজকনসাল্টিং। প্রজেক্টের বিল্ডিং নকশার দায়িত্ব তার হাতে থাকলেও সত্যিকার নির্মাণের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না বলে জানান চিরিল্লো।
তিনি এ-ও বলেন, স্ট্রয়গাজকনসাল্টিংয়ের সঙ্গেই শুধু এ ব্যাপারে তার যোগাযোগ হয়েছে।
শুধুই অতিথি আপ্যায়নের স্থান, থাকার জন্যে নয়
যখনকার কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে স্ট্রয়গাজকনসাল্টিং ছিল সেই গুটিকয়েক কোম্পানির মধ্যে একটি, যেগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এনার্জি কোম্পানি গাজপ্রম থেকে আসা বিরাট বিরাট নির্মাণকাজের চুক্তিগুলো পেত। আর এই স্ট্রয়গাজকনসাল্টিংয়ের মালিক মানাসিরের ছিল গাজপ্রম কোম্পানির বস আলেক্সেই মিলার এবং পুতিনের বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে স্ট্রয়গাজকনসাল্টিং কার জন্যে বানাল ওই প্রাসাদ?
এর উত্তর চিরিল্লোর জানা নেই। তবে তিনি ভবনের লে-আউটের উদ্দেশ্য করে জানান, এটা কোনো বাসভবন হিসেবে তৈরি হয়নি; বরং অতিথিদের গ্রহণ করার জন্যে বানানো। আশেপাশে কোনো ফ্যামিলি এরিয়াও নেই এবং বাসভবনে কেউ সীসা বার বানায় না বলেও যুক্তি দেন তিনি।
চিরিল্লোর মতে, এটা এমন একটা প্রাসাদ, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা-বৈঠক হতে পারে। সেইসঙ্গে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, 'পুতিনের নিজের থাকার জন্য এত বড় প্রাসাদ কেন বানাতে হবে? রাশিয়ার সব ঘরের দরজা তার জন্যে খোলা; একটা ফোনকল করামাত্র তিনি যেকোনো ভিলায় থাকতে পারবেন।'
পাহারায় এফএসবি সিক্রেট সার্ভিস গার্ড
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রাসাদে রয়েছে একটি নো-ফ্লাইং জোন। প্রেসিডেন্সিয়াল সিকিউরিটি সার্ভিস ও গোপন গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি মিলে প্রাসাদটি পাহারা দেয়। এমনকি প্রাসাদের সম্মুখভাগে সমুদ্র এলাকাজুড়ে জাহাজ চলাচলও নিষিদ্ধ।
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে, সুরম্য এই প্রাসাদ ঘিরে রয়েছে যথেষ্ট রহস্যের জাল।
আর এই প্রজেক্টের পেছনে পুতিনের যদি কোনো হাত না-ই থাকে, তাহলে এই চুক্তি যিনি করেছিলেন, তিনি কেন ক্রেমলিনকে এই ঝামেলার হাত থেকে বাঁচাতে মুখ খুলছেন না?
এদিকে, সম্প্রতি পুতিনের জুডো পার্টনার আর্কাদি রোটেনবার্গ দাবি করেছেন, তিনিই এই প্রাসাদের বর্তমান মালিক এবং তিনি এটি কয়েক বছর আগে কিনে নিয়েছেন। তবে তিনিও এ ব্যাপারে কোনো দলিল দেখাতে পারেননি।
প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ কোনো কাজে যুক্ত নন বলে দাবি করলেও চিরিল্লো জানান, তিনি ২০-৩০ বার ওই প্রাসাদে গিয়েছেন। শেষবার তিনি সেখানে যান ২০১৪ সালের বসন্তে।
প্রাসাদ-রহস্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রাসাদ থেকে একটি ১০০ মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ গিয়ে পৌঁছেছে সাগরের পানিতে এবং চিরিল্লোর দাবি, তিনি এ ব্যাপারেও কিছুই জানেন না।
স্থপতিকে রাশিয়ার নাগরিকত্ব
নাভালনির দল আরও যে তথ্য বের করেছে, তা হলো, গেলেনডজিকের প্রপার্টি রেজিস্টারে রয়েছে চিরিল্লোর নাম। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, চিরিল্লোও কিছুদিনের জন্য এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। যদিও নাভালনির দাবি, চিরিল্লো তা এত দামি প্রাসাদ নির্মাণের পুরস্কার হিসেবে পাকাপোক্তভাবেই পেয়েছেন। নাভালনি একে 'পুতিনের গোপনীয়তা রক্ষার পুরস্কার' বলে অভিহিত করেন।
তবে নাভালনির এমন দাবি উড়িয়ে দিয়ে চিরিল্লো বলেন, 'আমার পোর্তো সারভোতে ৩টি ভিলা রয়েছে। আমি গরিব নই। সামান্য কয়েক হাজার ডলারের জন্য আমি খারাপ কাজে নামব না।'
এদিকে, ২০১৪ সালে পুতিন নিজে এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে চিরিল্লোকে রাশিয়ার নাগরিকত্ব দিয়েছেন সম্মান হিসেবে। চিরিল্লোর ভাষায়, এটা রাশিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে তিনি পেয়েছেন; শুধু একটা প্রজেক্টের জন্যে নয়।
মস্কোর সঙ্গে চিরিল্লোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় ২০১৫ সালের দিকে। তিনি এখন পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করছেন বলে জানান। বর্তমানে তিনি পোপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন আর্কটিক ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
নানা রহস্যে পরিপূর্ণ গেলেনডজিকের প্রাসাদ নিয়ে নাভালনির ভিডিও যদিও চাঞ্চল্য তৈরি করেছে, তবে তা এখন আর সেই আগের অবস্থায় নেই। প্রাসাদের দামি ইতালীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং মলিন হয়েছে সৌন্দর্য।
'আপনি যদি একটা ঘর গরম করেন আর জানালা খুলে না দেন, তাহলে অনেক কিছুই গড়বড় হতে পারে', বলে শেষ করেন চিরিল্লো।
- স্পিগেল থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার তমা