২৫ মার্চে নৃশংসতা চালানো পাকিস্তান আজ কোন অবস্থানে!
আজ সেই কালো রাত্রি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, এ রাতেই নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেইরাতে এবং তার পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশের শহর-গ্রাম-প্রান্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী এবং এই হত্যাযজ্ঞের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা। পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭১ এর নয় মাস সময়কাল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। ১৯৭২- এর ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন। দেশের মাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে সেই সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল দেশসমূহ বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়েছিল; কেবলমাত্র সৌদি আরব এবং চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ সেই দলে ছিল না।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক যে দেশটির জন্ম হয়েছিল, তা ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। জন্মের সময় ঘোষণা করেছিল দেশটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হবে। দেশটি প্রথম যে সংবিধান ১৯৫৬ গ্রহণ করেছিল- তাতেও তারা পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করেছিল। যদিও তাদের সেই সংবিধান সাময়িক সংবিধানে পরিণত হয়, যা মাত্র এক বছরের জন্য কার্যকর ছিল। ১৯৭১ সালে দেশটিতে কোন সংবিধান ছিল না, তবুও সেই ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষিত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর এই বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর উদযাপিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল। ৫০ বছর আগে বিভক্ত হওয়া এই দুটি খন্ডের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই বিভক্তি অথবা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি কতটা বাস্তব ছিল এ ভূখন্ডের মানুষের জন্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, বাংলাদেশে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২,০৬৪ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের সরকারি তথ্য, এর পরিমাণ ১৩৫৫ ডলার। বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২.৬ বছর হলেও, পাকিস্তানে তা ৬৭ বছর। গেল ফেব্রুয়ারি নাগাদ বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৪৩.৮২ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাহার ৯৭.৩৪ শতাংশ, পাকিস্তানে যা মাত্র ৭২ শতাংশ। বিবিএস অনুসারে, মহামারি সময়কালেও ৫.২৪ শতাংশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি আমরা, সেখানে পাকিস্তানের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে মাইনাস দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে।
উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একটি ক্ষেত্রে প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে অবস্থিত। ১৮০টি দেশের মধ্যে গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০২০ এ ভারতের অবস্থান ছিল ১৪২, তারপর ১৪৫তম স্থানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছিল ১৫১ তম স্থানে। এই একটি বিষয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে। পাকিস্তান দেশটি দীর্ঘ ৭০ বছর যে ধর্মীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। তারই পরিণতি অর্থনৈতিকভাবে এতটা পিছিয়ে পড়া। সামরিক খাতে আকাশচুম্বী ব্যয় করে পৃথিবীর ষষ্ঠ অবস্থানে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর এই ব্যাপক ব্যয় দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রেখেছে।
প্রতিবছরের মতো এবছরও ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উদ্দেশ্যে একটি পত্র প্রেরণ করেছেন। যে পত্রে ইমরান খানকে দেশের মাটিতে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিলুপ্ত করে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সহযোগিতার জায়গায় সৃষ্টি করার আহ্বান করেছেন তিনি। বর্তমান পাকিস্তান সরকার কাঠামোতে যদিও একটি পার্লামেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি দৃশ্যমান- কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মূল ক্ষমতা নিয়ে নেপথ্যে আছে সেনাবাহিনী। একই অবস্থা বিরাজমান আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে একই অবস্থা।
পাকিস্তান নামক দেশটির আরেকটি তথ্য আমরা দেখতে পাই যে বছরে কতগুলো সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম দেশব্যাপী চলছে- তাতে কত লোক নিহত হচ্ছে। পাকিস্তানের এই ধর্মতাত্ত্বিক রাজনীতির পরিণতি আজকের অবস্থা। আমাদের স্বাধীনতা উদযাপন এর ৫০ বছরে লক্ষ্য রাখতে হবে বাংলাদেশে যেন এই দর্শন শিকড় বিস্তার করতে না পারে, তবুও মাঝেমাঝে চমকে যেতে হয় বাংলাদেশে এই আদর্শে বিশ্বাসীদের বিচরণ দেখে। হলি আর্টিজান ঘটনার ভেতর থেকে সরকার কঠোর হাতে এদেরকে দমন করলেও; আরেকদিকে এরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিকে রূপান্তরের চেষ্টা করছে। তাই পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর বাকস্বাধীনতার জায়গাটা একটু বেশি বলেও মনে হয়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক