স্বাধীনতার ৫ দশক পর ভূরাজনীতির কেন্দ্রে বাংলাদেশের উত্থান
পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার ৫০ বর্ষপূর্তি পালন করছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নে সাফল্যের জন্যেও দেশটি সমাদৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব অবশ্য তেমন একটা আলোচনায় আসছে না। অথচ তার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র সরে গেছে আরও পূর্বদিকে। বৈরিতার কারণে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের জন্য একদা রুদ্ধ- উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমানায় দেখা দিয়েছে পুনঃএকত্রীকরণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
আজ দ্বিতীয় আরেক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ- যে মুক্তি বিচ্ছিন্নতা মোচন করবে এবং একইসাথে আঞ্চলিক পর্যায়সহ এই অঞ্চলের বাইরেও শক্তিশালী প্রভাব রাখতে ঢাকার সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে- ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুনতর নৌ যোগাযোগের সম্ভাবনা যুক্ত করে।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন দেশটি টিকে থাকবে কিনা- তা নিয়েই অনেকে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তারা কল্পনাও করতে পারেননি। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ভূখণ্ড থাকাকালে; দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ আর রোগব্যাধির তাড়নায় ব্যাপক প্রাণহানির সঙ্গে জড়িত ছিল বাংলাদেশের নাম।
তবে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী আকারে ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে যায়। অর্থনীতির পরিধি সম্প্রসারণের এই গতি অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালেই স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ। আর ২০৩০ সাল নাগাদ পরিণত হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে। ইতোমধ্যেই, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং নারী ক্ষমতায়নের মতো নানা সূচকে ঢাকার সফলতায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো।
তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে দিনবদলের সুবাদে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রভাবকে সঠিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়াটাও চোখে পড়ে না। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির কথা উঠলেই তার কেন্দ্রীয় আলোচনা প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে- ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা। দীর্ঘদিন ধরে এই মনোভাব চলে আসছে। ভারত ও পাকিস্তানের একাডেমিক মহল, গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং নীতি গবেষণা সংস্থাগুলো দূরদৃষ্টির অভাবে শুধু মনোযোগ দেয়- কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদ, পরমাণু অস্ত্র, আফগানিস্তান এর মতো নানা ইস্যুতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের পরস্পরবিরোধী নীতি বিশ্লেষণে। দৃষ্টিকোণের স্ব-আরোপিত এই সীমাবদ্ধতায় এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর উন্নয়ন ও অগ্রগতি উপেক্ষিত হয়। বাংলাদেশও এভাবেই তার সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত।
কৃত্রিম সেই আবরণ সরিয়ে খোলা চোখে দেখলেও আজকের উপমহাদেশে সেই উপেক্ষিত দেশগুলোর কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। যেমন আকারে তুলনামূলক ছোট দেশ শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের কথাই বলা যাক; ভারত মহাসাগরে ব্যস্ত নৌ-বাণিজ্য পথে অবস্থিত দেশদুটি এখন ভারত, চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক নৌশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বড় আগ্রহের কেন্দ্র। আবার হিমালয় পর্বতমালায় ভারত ও চীন বেষ্টিত দুটি দেশ- নেপাল ও ভুটান হয়ে উঠেছে দিল্লি ও বেইজিংয়ের তীব্র ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ।
এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ আকারে বড়, কিন্তু সেটাই দেশটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের একমাত্র কারণ নয়। বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ বা প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা আছে বাংলাদেশের। প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ৮০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন বিশ্বের নানান দেশে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক থাকেন উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে। ইংরেজি ভাষী দেশগুলোতেও বাড়ছে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন।
তাছাড়া, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে উত্তরে নেপাল ও ভুটান এবং উত্তরপূর্বে চীন ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব বেশি নয়। তাই এসব দেশের কাছে আকর্ষণীয় সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের কদর বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারতের জন্যেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মজবুত হয়েছে দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত সহযোগিতা, রাজনৈতিক সহাবস্থান এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের বন্ধন। এই অঞ্চলের বাইরেও বিশ্বস্তরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ঢাকা।
প্রধানত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর ভর করে বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে রপ্তানি নির্ভর দেশে। ২০১৯ সালে এই খাত থেকে ৩ হাজার কোটি ডলার আয় হয়। এমনকি ১৫০টির দেশে রপ্তানির মাধ্যমে চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হলো বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পরই বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অঙ্গনে পা রেখেছিল বাংলাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র- পাকিস্তান জন্মের ২৫ বছর পর সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করে যে, ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে কোনো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম আজো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও- বড় আকারের কিছু সন্ত্রাসী হামলার পর ধর্মীয় উদারীকরণ ও উগ্রপন্থা দমনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের কট্টরপন্থী রাজনীতি সীমিত করতে সফল হয়েছে ঢাকা। পশ্চিমা বিশ্বের চোখে যা দেশটির বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর একটি বড় গুণ।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অর্থনীতিতে সফল না হলে বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক চরিত্র তেমন গুরুত্ব পেতো না। পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দুটি তুলনার দিকে তাকালেই বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যহারে এগিয়ে যাওয়ার চিত্র ফুটে ওঠে।
প্রথমত, ২০১৯ সালে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে পাকিস্তানের আসন কেড়ে নেয় বাংলাদেশ। সেবছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৩০৩ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের ২৭৯ বিলিয়ন ডলার। দু'য়ের মধ্যে এই পার্থক্য আগামীদিনে বাড়ার সম্ভাবনাই প্রবল। বাংলাদেশ যখন মহামারির অভিঘাত সামলে উঠে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছে, তখন চরম দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত পাকিস্তান।
দ্বিতীয়ত, গেল বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, মাথাপিছু জিডিপি'তে সেবছর ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। মহামারিতে বিপাকে পড়া ভারতীয় অর্থনীতির আলোকে করা ওই পরিসংখ্যানটি প্রকৃত অবস্থা নির্দেশ না করলেও- তা অবশ্যই বাংলাদেশের অগ্রগতির দিকে আলোকপাত করে। বাংলাদেশ যে উপমহাদেশের বড় রাষ্ট্রগুলোর দাবা খেলায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে না- এটা ছিল তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
তার চেয়েও বড় কথা ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে; দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবায়িত না হওয়া নিয়ে অহেতুক বিলাপের সময় চলে গেছে। বাংলাদেশের উত্থানই এনে দিয়েছে সেই সুযোগ। আঞ্চলিক ফোরাম সার্কে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় রাজি না হলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই আর। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে নেপাল, ভুটান ও ভারত তৈরি করতে পারে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন কাঠামো। এমনকি, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে সংযোগের পরিধি। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক এই সম্পর্কের বন্ধন জোরদারে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখবে।
-
লেখক: সি. রাজা মোহন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক। তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক কমিটির সাবেক সদস্য - ফরেন পলিসি থেকে অনূদিত