যুক্তরাষ্ট্রের জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাকসিন আমদানি করবে সরকার
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ইউনাইটেড নেশন্স ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ইমার্জেন্সি ফান্ড (ইউনিসেফ) এর মাধ্যমে জনসনের ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এই ভ্যাকসিন আমদানিতে অর্থায়ন করবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি থাকলেও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সময়মত ভ্যাকসিন পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, মার্চের শেষে বাংলাদেশকে দুই কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার কথা ছিল কোভ্যাক্সের।
ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর কোভ্যাক্স ই-মেইলে বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে। টিকার সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের চলমান টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই অক্সফোর্ডের টিকার বিকল্প হিসেবে জনসনের ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করার পর বুধবার ডোজের জন্য টিকা বরাদ্দ রাখতে গিয়ে বুধবার সারাদেশে ৫০,৭৫২ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এটি গত ৪২ দিনের গড় টিকাদানের অর্ধেকেরও কম। ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১২৭,৮৬৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, জনসনের ভ্যাকসিনের কোল্ডচেইন অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মতোই, ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা সম্ভব, সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই এই কোল্ডচেইন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একক ডোজের এই ভ্যাকসিনের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৬-১০ ডলার। বাংলাদেশ ১০ ডলার দাম ধরে এই ভ্যাকসিন কেনার উদ্যোগ নিয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এডিবি বাংলাদেশকে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছে, সেখান থেকে জনসনের ভ্যাকসিন মূল্য পরিশোধ করা হবে। এপ্রিল মাসে এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জনসনের ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব মো. আব্দুল মান্নান বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বিষয়ে একটি সভা হয়েছে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জনসনের ভ্যাকসিন আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি চূড়ান্ত হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।'
দেশের কোন মানুষ যাতে টিকাদান কর্মসূচির বাইরে না থাকে, সেজন্য আরও তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আমদানি করতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আগে থেকেই জনসনের ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভারত ২৫ মার্চ ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করার পর জনসনের ভ্যাকসিন কেনার উদ্যোগে গতি বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানা ও ফাইজার ও চীনের সিনোভ্যাকসহ বিভিন্ন ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য উপযুক্ত কোল্ডচেইন না থাকায় জনসনের ভ্যাকসিন কেনা হলে কোল্ডচেইনে বাড়তি খরচের দরকার হবে না।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে একটি ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর না থেকে একাধিক উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই প্রেক্ষাপটে জনসন অ্যান্ড জনসন এর ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক বলে মনে করেন তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'জনসন অ্যান্ড জনসন এর ভ্যাকসিন আমদানির পরিকল্পনা করা হলে সেটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আমাদের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বিকল্প হলো জনসনের ভ্যাকসিন। কারণ এই ভ্যাকসিন সিঙ্গেল ডোজ এবং আমাদের এ ভ্যাকসিন সংরক্ষণের কোল্ড চেইন রয়েছে। জনসনের ভ্যাকসিন দেরিতে তৈরি হওয়ায় এর কার্যকারিতা বেশি। এই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ৯০%'।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, 'সরকার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা করছে। এতে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে সেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। সিঙ্গেল ডোজের ভ্যাকসিন দেয়া হলে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা আরো সহজ হবে'।
বাংলাদেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫৩,৭০, ৪৩১ মানুষকে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। ভ্যাকসিনেশন শুরুর প্রথম সপ্তাহে দিনে গড়ে ১ লাখ ২৯ হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে ভ্যাকসিন নেয়ার হার বাড়ে। ভ্যাকসিনেশনের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিনে গড়ে ২ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন ভ্যাকসিন নিয়েছেন, যা একদিনে সর্বোচ্চ।
১১ মার্চ থেকে দিনে ভ্যাকসিন গ্রহীতার সংখ্যা এক লাখের নিচে নেমে আসে। দিন দিন ভ্যাকসিন নেয়ার সংখ্যা কমতে কমতে এখন তা ৫০ হাজারে নেমে এসেছে।
হঠাৎ ভ্যাকসিন নেয়ার সংখ্যা কমে আসার বিষয়ে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, 'আমরা এখন একটু ধীর গতিতে ভ্যাকসিন দিচ্ছি। সেকেন্ড ডোজের জন্য ভ্যাকসিন রাখা ও ভারতের ভ্যাকসিন রপ্তানির নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন চলে আসলে ইউনিয়ন পর্যন্ত ক্যাম্পেইন চালিয়ে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে'।
সেরাম ইনস্টিটিউট, বেক্সিমকো ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশকে তিন কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার কথা ভারতের। জানুয়ারি মাসে প্রথম ৫০ লাখ ডোজ সরবরাহের পর ফেব্রুয়ারিতে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিয়েছে ভারত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যাপারে মোদি আশ্বস্ত করেছেন বলে জানা গেছে।
এপ্রিল শুরু হলেও মার্চের টিকা কবে পাবে বাংলাদেশ তার কোন শিডিউল সেরাম ইনস্টিটটিউট কিংবা বেক্সিমকো থেকে এখনও পাওয়া যায়নি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ২৫ মার্চ রাতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে বলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আমদানি করা ৭০ লাখ ডোজের পাশাপাশি ভারত থেকে দু'দফায় ৩২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার পেয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার পর্যন্ত সরকারের কাছে রয়েছে ৪৮,২৯,৫৬৯ ডোজ ভ্যাকসিন। অর্থাৎ, নতুন করে ভ্যাকসিন না পেলে প্রথম ডোজ নেওয়া সবাইকে সেকেন্ড ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে টিকার সংকট দেখা দেবে।