নন্দীগ্রাম কি মমতাকে পরাজিত করবে?
এপ্রিল ফুলের দিন কে যে ফুল (বোকা) হবে তা জানতে পারা যাবে মে মাসের ২ তারিখে। আজ নন্দীগ্রামের ভোট। নন্দীগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে ২০০৭ সালে ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিবর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে, তা নিয়ে এক বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন মমতা ব্যানার্জি তার জনসভায়। নির্বাচনী ময়দানে তিনি জানালেন ২০০৭ সালে সেই ঘটনায় শুভেন্দু অধিকারী ও তার পিতা শিশির অধিকারী গুন্ডাকে পুলিশের পোশাক পরিয়ে জনতার উপর গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। পুলিশের ওই গুলি ছোঁড়ার ঘটনায় প্রায় ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছিল।
নন্দীগ্রাম নিয়ে উত্তেজনা চলছিল বেশ আগে থেকেই। যখন নন্দীগ্রাম প্রায় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল, তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বামফ্রন্টের বুদ্ধদেব বসু নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সরাসরি গুলিবর্ষণের নির্দেশ ছিল না। তখনকার সামগ্রিক ঘটনার পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয় যে, পুলিশ বাহিনী সেদিন ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে পুলিশের বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রমোশন ও ভালো পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ কর্মজীবন শেষ করে মমতা ব্যানার্জির দলে যোগ দিয়েছেন।
মমতা ব্যানার্জি পুলিশের পোশাক পড়া গুন্ডাদের গুলি চালানোর ঘটনায় সাক্ষী হতে চান। এই ঘটনা দীর্ঘ ১৪ বছর পর পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে প্রকাশ করল মমতা ব্যানার্জি।
অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের জন্য নন্দীগ্রামের মাটিতে কত বড় ষড়যন্ত্র ঘটেছিল সেই ২০০৭ সালে!
তৃণমূল কংগ্রেস প্রথমবার এই আসনে একজন মুসলিম নারীকে বিধানসভার মনোনয়ন দিয়েছিলে ২০১১'র নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি প্রথম পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয় নাই, কারণ তখন তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। মনমোহন সিং সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি, ২০০৯-২০১১ পর্যন্ত। পরে এক উপনির্বাচনে মমতা জয় লাভ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন।
২০১৬ সাল থেকে সেখানে বিধানসভার সদস্য মমতা ব্যানার্জির দক্ষিণ হস্ত ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, যে শুভেন্দু অধিকারী পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন, সেই শুভেন্দু অধিকারী নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, গত বছর করোনা মহামারি চলাকালে দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদান করেন।
নন্দীগ্রামের একটি বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকার কারণে শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামকে একটি সাম্প্রদায়িক বিভক্তির রাজনীতিতে রূপান্তরিত করেছেন। আর মমতা ব্যানার্জি তার পুরনো কলকাতার আসনটি ছেড়ে দিয়ে নন্দীগ্রামের আসনটি বেছে নিয়ে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। দুজনের জন্যই এটি মরণপণ লড়াই। শুভেন্দু অধিকারী নির্বাচনে পরাজিত হলে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়বেন। আর যদি এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি ২০০৭ সালে বহিরাগত গুন্ডাদের পুলিশের পোশাক পরিয়ে গুলি ছোড়ার মামলাটি রুজু করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মমতার এই অভিযোগে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। অতীতে বামফ্রন্টের সময়ে জমি নিয়ে যখন নন্দীগ্রামের মানুষ লড়াই করেছে, তখন তার মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভাজন ছিল না।
নন্দীগ্রামের মুসলিমরা এমনিতেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিকভাবে কৃষক এবং দিনমজুরের কাজ করে জীবন চালায় এই মুসলিমদের বড় অংশ।
নন্দীগ্রাম যেভাবে এখন সম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত তাতে নন্দীগ্রামের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, নির্বাচনের পর তাদের কী হবে? তারা কি সেই আগের মতন একই চায়ের দোকানে শেখ এবং বাবুরা চায়ের টেবিলে ঝড় তুলতে পারবেন? আগের দিনের মতন মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা একই জায়গায় বসে আড্ডা দিবেন? নির্বাচনের পরই তারা কি ভুলে যেতে পারবেন নির্বাচনের ফলাফল কি হয়েছে? আগে হলে তারা ভুলে যেতেন। অতীতে এমনি তাই ছিল তাদের নন্দীগ্রাম।
শুভেন্দু অধিকারী এই অঞ্চলের বিধানসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এলাকাটি তেমন উন্নয়নের মুখ দেখেনি। রাস্তাঘাট বা অন্য কোনো উন্নয়নের চাপ নন্দীগ্রামে আসেনি, এবং আশ্চর্য বিষয় হলো এই নির্বাচনে উন্নয়নর এ বিষয়গুলো নিয়ে কেউ ভাবছে না। ভাবছে মূলত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে।
মমতা ব্যানার্জি না শুভেন্দু অধিকারী- কেউ ২০০৭-এর জমির আন্দোলনে শহীদদের কথা মনে করছেন না। এই নির্বাচনের পরে কী হবে- এই হিসাবই এখানকার মানুষদের প্রধান আলোচনা।
ওই অঞ্চলের মুসলিম ভোটারদের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফর ও এখানে সংঘঠিত ঘটনাসমূহ আরও বেশি শঙ্কিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মোদি বিরোধী যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে নন্দীগ্রামে মুসলিম ভোটারদের মধ্যে একটি আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গত এক সপ্তাহে নন্দীগ্রামের ভোটকেন্দ্রগুলো সম্প্রদায়িকভাবে চূড়ান্ত বিভাজনের দিকে যাচ্ছে, উভয় সম্প্রদায়ের ভোটাররা। ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
লক্ষণীয় ভারতবর্ষব্যাপী যে নির্বাচন চলছে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে, বিজেপি সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করেছে পশ্চিমবাংলায়। এমনটা অভিযোগই এখন পশ্চিমবাংলার মানুষের। সবাই দেখছেন যে বিজেপি কেবলমাত্র ধর্মতত্ত্বের দ্বারা পশ্চিমবাংলাকে জয় করতে চাচ্ছে। গত একমাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যতগুলো জনসভা করেছেন, পশ্চিমবাংলায় তাতে অতীতে কোনো রাজ্যের নির্বাচনে এত জনসভা করেছেন বলে হিসাব পাওয়া যায় না। এর কারণ বিজেপি মনে করে যে ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার কখনোই বিজেপিকে সমর্থন করবে না, সুতরাং এই মুসলিম ভোটারদেরকে যদি পরাজিত করতে হয়, তাহলে ধর্মতত্ত্ব সবচেয়ে বেশি কাজ করবে।
এখন দেখা যাক কে এই আসন থেকে জয়লাভ করে! যার পরাজয় ঘটবে রাজনৈতিক মাঠ থেকে তাকে হারিয়ে যেতে হবে।
পশ্চিমবাংলায় বিজেপির বিজয় সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হবে। আসামের নির্বাচনও একই সময়ে। সে নির্বাচনেও বিজেপির জয়লাভ করা সম্ভব। ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবাংলা ও আসাম এই দুই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার একটি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতিক হেফাজতের ঘটনার পরে কোনদিকে যাবে সেই রাজনীতি আর কী আকার ধারণ করবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক