মাস্ক পরলেও নেই শারীরিক দূরত্ব, ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত-জমায়েত-শপিং
শুক্রবার সকাল আটটায় রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে লম্বা সারি। লাইনে দাঁড়াতে শারীরিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়টি মানছে না কেউই। তবে মাস্ক ছাড়া টিকিট দেয়া হবে না বিধায় সবাই মুখের মাস্কটা টেনে নিচ্ছেন। এরপর আবার যা তাই।
ওদিকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাইকে কিছুক্ষণ পরপর স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে ঘোষণা আসছে। ঘোষণা হলে সবাই একটু নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু একটু পরেই উদাসীন অধিকাংশ যাত্রী। মাস্ক পরলেও, শারীরিক দূরত্বের ব্যাপারে গাফিলতি সবার। অনেকেই যথাযথ নিয়ম মেনে পরেনি মাস্ক।
এ তো স্টেশনের চিত্র। ট্রেনের ভেতরের অবস্থা কেমন তা দেখতে স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ। এখানেও লোক সমাগম না করতে নিরাপত্তারক্ষীদের কড়াকড়ি আছে। তবে কে শোনে কার কথা। দাঁড়িয়ে থাকা লোকাল ট্রেনের কাছে যেতেই ভেতরের অবস্থা অনুমান করা যাচ্ছিল, যাত্রী বেশি।
টঙ্গীর যাত্রী সাহানা বেগম টিবিএসকে বলেন, 'টিকেট কেটে ট্রেনে উঠেছি বাড়িতে যাবো বলে। দুই সিটে একজন করে বসতে বলা হলেও মানুষ বেশি হওয়ায় পাশে বসতে দিতে হয়েছে। অনেকে আবার দাঁড়িয়েও যাচ্ছে'।
ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লোকাল ট্রেনগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে বেশি। তবে আন্ত:নগর ট্রেনে চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়ম মানার প্রবণতা বেশ ভালো। বসার ক্ষেত্রে এক সিট ছেড়ে বসেছেন অধিকাংশই। হকার প্রবেশেও আছে কড়াকড়ি ।
স্টেশন মাস্টার (ঢাকা) মো. রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'লোকাল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মানা কম হচ্ছে। এগুলো (লোকাল ট্রেন) বন্ধ করে দেওয়া ব্যতীত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। আমাদের লোকজন সারাক্ষণই যাত্রীদের সচেতন করছে। কিন্তু তারা মানছে না'।
ঢাকা বিভাগের মধ্যে প্রতিদিন ৫৪ টি লোকাল ট্রেন এবং ১৪৬ টি ট্রেন বিভিন্ন জেলায় ছেড়ে যায় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, 'আমরা অর্ধেক টিকেট বিক্রি করলেও যাত্রীরা ঠিকই গাদাগাদি করে যাতায়াত করে। তবে কয়েকদিন ট্রেনের যাত্রী তুলনামূলকভাবে কমেছে'।
এদিকে রাজধানীর সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের ভাড়া বাড়ার সাথে, বেড়েছে যাত্রীদের ভোগান্তিও। বৃহস্পতিবার থেকে লঞ্চগুলোতে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন এবং ভাড়া ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির নির্দেশনা থাকলেও, তা অনেক লঞ্চ মালিকই মানছেন না।
এদিন সকালে ঢাকার সদরঘাটের বিভিন্ন লঞ্চে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ লঞ্চই যাত্রী বোঝাই। ডেকে যাওয়া যাত্রীদের ক্ষেত্রে নেই শারীরিক দূরত্ব। এছাড়া কোনো লঞ্চেই দেখা যায়নি তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র। যাত্রীদের স্যানিটাইজ করার কোনো ব্যবস্থাও ছিল না।
বরিশালের স্বরুপকাঠী থেকে পরিবারসহ লঞ্চে ঢাকায় আসা যাত্রী রাজীব হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ভাড়া ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা নিয়েছে ঠিকই। তবে যাত্রী তো কম নেয়নি'।
লঞ্চের ছাদেও যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
দেখা যায়, ইলিশা ঘাট ও বরিশালে যাওয়া এম ভি গ্রীন লাইনে যাত্রী নেওয়া হয় ৪ জনের সিটের যায়গায় ৩ জন এবং ৬ জনের যায়গায় ৪ জন বসেছে। তবে যারা পরিবারসহ ভ্রমণ করেছে তাদের সবাইকে একসাথেই বসতে দেয়া হয়েছে।
চাঁদপুরগামী একটি লঞ্চের টিকেটম্যান আরিফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, আমাদের লঞ্চে ভাড়া বাড়ানো হয়নি এছাড়া যাত্রী আগের মতোই নেওয়া হচ্ছে।
বরিশালের ভাড়া ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করা হয়েছে জানিয়ে গ্রীন লাইনের কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এখানে যাত্রীর চাপ কমই থাকে। পরিবারসহ গেলে একসাথে সিট দিচ্ছি। আর অন্যদের ফাঁকা ফাঁকা করে বসাচ্ছি'।
রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, কমলাপুরসহ কয়েকটি বাসস্ট্যান্ড সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর ফলে কাউন্টারে যাত্রীদের সাথে দরকষাকষিতে নিয়মিত তর্ক হচ্ছে।
অধিকাংশ যাত্রীই অতিরিক্ত ভাড়া দিতে নারাজ। এমনকি যাত্রীরা নিজেরাই পাশাপাশি সিটে যেতে আগ্রহী। কিন্তু ভাড়া কমানোর পক্ষে তারা। ওদিকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যাতায়াত কম হচ্ছে। তাদের মালিকদেরও পোষাচ্ছে না।
সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে ঢাকা থেকে জুড়ি (সিলেট) যেতে শ্যামলী টিকেট কাউন্টারে কথা বলছিলেন সাথী আক্তার। তার দাবি তিনি তার মেয়েকে নিয়ে পাশাপাশি বসেই যাবেন। তাতেও যেন ভাড়া আগেরটা রাখা হয়।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সকালের ট্রেনে টিকেট না পেয়ে বাসে যাবো বলে এসেছি। এখন দেখি ৫০০ টাকার ভাড়া ৮০০ টাকা। বাসায় তো মেয়েকে নিয়েই থাকি। কিন্তু বাসে যেতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আলাদা সিটে'।
শ্যামলী কাউন্টারের কর্মকতা আরিফ হেসেন টিবিএসকে বলেন, 'ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বিরক্ত। সারাক্ষণই যাত্রীদের সাথে তর্ক করতে হচ্ছে। বার বার বুঝাতে হচ্ছে। আবার আগের মতো যাত্রীও পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে ২/১ টা ট্রিপ বাদ অন্য গাড়ীতে যাত্রী পাঠাতে হচ্ছে'।
তবে ঢাকা থেকে কুমিল্লা, লাকসাম, ফেনী, নোয়াখালীতে যাওয়া বাসগুলোতে ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া নিয়েও নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। কম দূরত্ব হওয়ার এই সুযোগ নিচ্ছে তারা এমন অভিযোগ যাত্রীদের।
এদিকে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে রাজধানীর শপিং সেন্টারগুলোতে যেন শপিংয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে সাবাই। শুক্রবার রাজধানীর নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান ও পান্থপথ এলাকার শপিং মলগুলোতে অন্তত সেই চিত্র দেখা মিলেছে।
বসুন্ধরা শপিং মলে মোবাইল কিনতে আসা নান্নু মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'মোবাইল কিনতে এসেছি৷ সাথে পরিবার নিয়ে একটু ঘুরলাম। চেষ্টা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। তবে কি আর বলব, দেশে নিয়ম তো কেউ মানে না৷ করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে, ভীড় যেন আরও বেড়েছে'।
আরেকজন ক্রেতা মাহফুজ আলমের হাতে বেশ কয়েকটি শপিং ব্যাগ। সাথে ছোট ভাগ্নে দুই জন। তিনি বলেন, 'ছুটির দিনটা পরিবারের কাজ করেই কাটে। সামনে তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আবার ঈদ আছে। এজন্য কিছু কেনাকাটা করে রাখছি'।
জেন্টেল পার্কের ক্যাশ ম্যানেজার নাইম হোসেন বলেন, 'মানুষ সমাগাম বেশি। তবে আমাদের বেচাকেনা কম। অনেকে তো ঘুরতে আসে। যেহেতু মলে মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেয় না, সুতরাং সবাই মাস্ক পরে ঠিকই। শোরুমে দূরত্ব রেখে দাঁড়ানোর চিহ্ন দেওয়া আছে কিন্তু তা কেউই মানছেন না'।
'আমাদের এখানে কাস্টমার আগের মতোই আসছে। বিক্রি কিছুটা কমেছে৷ ক্রেতারা কিছু কিনতে আসলে মাস্ক ব্যতীত কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায় না'।
ছুটির দিন হওয়ায় এদিন রাজধানীর গণপরিবহনে বাড়তি চাপ অন্য দিনের মতো লক্ষ্য করা যায়নি। তবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা থাকার কারণে সকালে এবং পরীক্ষা শেষে কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাসে ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
বিকেলের দিকে গণপরিবহনে চাপ ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। মিরপুর থেকে সদরঘাটগামী বিহঙ্গ পরিবহনের হেলপার রবিউল ইসলাম বলেন, 'আমরা তো এক সিটেই যাত্রী নিয়ে বাস চালাচ্ছি। স্টপেজে অনেকে দাড়িঁয়ে থাকলেও উঠানোর উপায় নেই'।
গণপরিবহনের চাপ অনেকটা স্বাভবিক থাকলেও শুক্রবার রাজধানীতে বই মেলা এবং মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে জমায়েত লক্ষ্য করা গেছে। পরীক্ষা উপলক্ষ্যে ঢাকার বাহিরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই মেলামুখী হওয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় মেলায়ও ভিড় ছিল বেশি।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার সহকারী শুব্রা বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, 'সন্ধ্যার ছুটির দিনে অনেকে ঘুরতে আসায় অন্যান্য দিনের তুলনায় মানুষের চাপ একটিু বেশি। তবে মেলা প্রাঙ্গ্ণে কাউকেই মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া বড় কোন জমায়েত না করার জন্য নিয়মিত নজরদারি হচ্ছে'।
রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ কেন্দ্রে নরসিংদী থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন আহসান আহমেদ। বাবা আলিম আহমেদকে নিয়ে পরীক্ষা শেষে বইমেলা ঘুরেছেন তারা। মেলা ঘুরে রাতেই বাড়ীতে ফিরবেন।
আহসান আহমেদ বলেন, 'কেন্দ্রের সামনে তো এর চেয়ে বেশি ভিড় ছিল। সবাই ঠেলাঠেলি করে, গায়ে গায়ে লেগে প্রবেশ করেছি। আবার দেখা গেল ভেতরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাধ্যতামূলক। এখানে তো অন্তত লাইন ধরে প্রবেশ করতে হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রের মতো খারাপ অবস্থা না'।
কোভিড সংক্রমণের সময়ে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা
কোভিড-১৯ এর উদ্বেগজনক সংক্রমণের মধ্যেই শুক্রবার ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার বেলা ১০টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৫টি কেন্দ্রে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়, যা বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে। সারা দেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আবেদন করেছিলেন।
চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এ কে এম আহসান হাবিব বলেন, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে।
তবে প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিশাল ভিড় দেখা গেছে।
রাকিব হাসান চৌধুরী নামে একজন অভিভাবক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পরীক্ষার কেন্দ্রের আশেপাশে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা কার্যকর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে'।
জাতীয় ও রংপুর চিড়িয়াখানা বন্ধ
শুক্রবার (২ এপ্রিল) থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানা দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন ।