২২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডুবছে আরএসআরএম
চট্টগ্রামের ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপ। যেটি আরএসআরএম (রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস) নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ঘিরে প্রায় ৮০০ কর্মী উৎপাদন কাজে নিয়োজিত ছিল।
কিন্তু ৪০ কোটি টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে এর দুটি কারখানা গত সাড়ে তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন বেতন বকেয়া হয়ে পড়ায় চাকুরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে বেশিরভাগ শ্রমিক।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ঋণ পরিশোধের অবস্থাও শোচনীয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে দীর্ঘদিনেও সেই ঋণ শোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ১০টি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২২০০ কোটি টাকা বকেয়া রেখে ডুবতে বসেছে এই গ্রুপটি।
এই পাওনা আদায়ে গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২০ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের দায়ের করা দুটি এনআই অ্যাক্ট (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট) মামলায় গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে বন্ধক রাখা সম্পত্তির পরিমাণও খুবই নগন্য। ফলে বিশাল অংকের এই ঋণ আদায়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছে্ন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা।
বুধবার সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়- নগরীর নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় অবস্থিত আরএসআরএম'র দুটি কারখানা বন্ধ। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও কারখানা দুটি থেকে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারখানার ভেতরে যাওয়া-আসা করতে দেখা যায় নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ৪০ কোটি টাকা বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় আরএসআরএম গ্রুপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
"বেশ কিছু দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হয়ে পড়ছিল। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর প্রতিষ্ঠানটি দুইবার উচ্চ আদালত থেকে কিস্তিতে পরিশোধের আদেশ নিয়ে আসে। কিন্তু কিস্তিতেও বিল পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে প্রতিষ্ঠানটি আবারো উচ্চ আদালতে যায়। কিন্তু সর্বশেষ আদালত সম্পূর্ণ বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ দেন। এরমধ্যে বিল শোধ করতে না পারায় প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে," বলে জানান পিডিবি'র এই কর্মকর্তা।
রতনপুর গ্রুপের পরিচালক মারজানুর রহমান বলেন, "বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার মেরামতের প্রয়োজনে গত কিছুদিন ধরে আমাদের কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আশা করছি, আগামী সপ্তাহের মধ্যে আমরা পুনরায় উৎপাদনে যেতে পারবো"। তবে ব্যাংক ঋণের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি এই পরিচালক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানাটিতে নিয়োজিত এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর থেকে দুই কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বকেয়া হয়ে পড়েছে দুই কারখানার প্রায় ৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন। বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকুরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। এখন দুই কারখানা মিলে প্রায় ৬০-৭০ জন নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োজিত রয়েছে।
জনতা ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও লালদীঘি করপোরেট শাখার প্রধান গোলাম মোস্তফা টিবিএসকে বলেন, রতনপুর গ্রুপের কাছে প্রায় ১২শ কোটি টাকার পাওনা আটকে রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরেও ঋণের সেই টাকা শোধ করছে না। এই পাওনার বিপরীতে গ্রুপটির ৩১ দশমিক ১৬ একর জমি বন্ধক রয়েছে ব্যাংকের কাছে। যা ঋণের তুলনায় খুবই সামান্য।
রতনপুর গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা জনতা ব্যাংক লালদিঘী শাখার। এরমধ্যে মেসার্স মর্ডান স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪০৯ কোটি টাকা, মেসার্স রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ৩১৩ কোটি টাকা ও এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ৪৮২ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে মামলা দায়ের করেছে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট শাখা। এই পাওনার বিপরীতে তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে ৬ টি মামলা দায়ের করেছে ব্যাংক। এর মধ্যে এনআই অ্যাক্টে দায়ের করা দুই মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে কারখানার কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ জাহাজ) আমদানি, অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় আরএসআরএম গ্রুপ। এরমধ্যে দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের সাথে ভালো ব্যবসা করে। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে ঋণের টাকা পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার।
রতনপুর গ্রুপের কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থাৎ ৬৩৪ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এর মধ্যে মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪৬২ কোটি টাকা ও রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ১৭২ কোটি পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির লালদীঘি শাখার। এই ঋণ আদায়ে গ্রুপটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে মোট ১২ টি মামলা দায়ের করেছে ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৬-২০০৮ সালের মধ্যে ইস্পাত শিল্পে বিনিয়োগের জন্য সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেড। তবে দীর্ঘ সময় পরও ঋণের টাকা ফেরত দেয় নি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা।
এছাড়া গ্রুপটির অপর প্রতিষ্ঠান রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ১৭৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে রি-শিডিউল করার পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঋণটি আবারো শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে। এই পাওনার বিপরীতে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির মোট ৫৩০ শতক জমি বন্ধক রয়েছে।
মডার্ন স্টিলের বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থঋণ আদালতের মামলাটি পত্রিকার মাধ্যমে সমন জারির জন্য রয়েছে। এছাড়া গ্রুপটির দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১১ টি এনআই অ্যাক্টে মামলা রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম ও লালদীঘি করপোরেট শাখার প্রধান মো. ইয়াকুব মজুমদার বলেন, "রতনপুর গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে এই শাখার ঋণ শোধ করছে না। আমরা প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি"। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইউনুস ভূঁইয়া দ্রুত ব্যাংক ঋণ পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে (২০১৩ সাল) আগ্রাবাদ শাখায় ব্যবসা শুরু করে রতনপুর গ্রুপের রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর পরের বছরই অর্থাৎ ২০১৪ সালেই ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ৫৬ কোটি টাকা।
২০০৭ সালে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মডার্ন স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। এরপর ঋণটি খারাপ হলে সরকারের লার্জ লোন রিস্ট্রেকচার সুবিধার সময় ঋণটি রিস্ট্রেকচার করা হয়। যা ২০১৪ সালে টাইম এক্সেটনশন করা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ট্রাস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার পাওনা ৬০ কোটি টাকা।
২০১৫ সালে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের সাথে ব্যবসা শুরু করে রতনপুর গ্রুপের এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। ওই সময় ৫০ কোটি টাকা টার্ম লোন নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। মাঝখানে কিছু টাকা শোধ করলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সুদাসলে পাওনা ৫৫ কোটি টাকা।
প্রাইম ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ২০১৩ ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপের এস এম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। বর্তমানে এস এম স্টিলের কাছে প্রাইম ফাইন্যান্স চট্টগ্রাম শাখার পাওনা ২৪ কোটি টাকা। যার পুরোটাই শ্রেণিকৃত হয়ে রয়েছে। এস এম স্টিলের কর্ণধারের বিরুদ্ধে গত বৃহষ্পতিবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতারণার অভিযোগে ৪২০ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছে প্রাইম ফাইন্যান্স।
রতনপুর গ্রুপের রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির জুবিলী রোড শাখা থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানির জন্য ঋণ সুবিধা নিলেও গত কয়েক বছর ধরে ঋণ পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
এছাড়াও রতনপুর গ্রুপের কাছে রূপালী ব্যাংক, প্রিমিয়ার লিজিং ও বিডি ফাইন্যান্সের বড় অংকের পাওনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে বিডি ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একটি এনআই অ্যাক্ট মামলা দায়ের করেছে।
ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় রতনপুর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাকসুদুর রহমান, চেয়ারম্যান শামসুন নাহার রহমান, এমডির সহোদর ইউনুস ভূঁইয়া, দুই ছেলে মিজানুর রহমান ও মারজানুর রহমান, মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিনকে বিবাদী করা হয়েছে।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, জনতা ব্যাংকের দুটি মামলায় আরএসআরএম গ্রুপের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বাসায় গিয়ে বিবাদীদের কাউকে পাওয়া যায় নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৪ থেকে চট্টগ্রামে শিপ ব্রেকিং ও ইস্পাত খাতে ব্যবসা করে আসছেন নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার মাকসুদুর রহমান। শুরু থেকে ধীর গতিতে ব্যবসা করলেও ২০০৪-০৫ সালের দিকে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ নেন তিনি। দীর্ঘদিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ও ব্যাংকের বড় কর্তাদের সাথে সখ্যতা করে সহজে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নেয় আরএসআরএম। তবে ঋণ নেয়ার প্রথম কয়েক বছর ব্যাংকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করলেও ২০১১-১২ সালের পর ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। এরমধ্যে ঋণ গ্রহণের এক দশক পার হলেও ঋণের টাকা ফেরত পায় নি অনেক ব্যাংক।
পাওনাদার ব্যাংকের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রতনপুর গ্রুপ প্রথম দিকে ব্যবসার জন্য ঋণ নিলেও পরে শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছে অসৎ উদ্দেশ্যে। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসার নামে ব্যাংক ঋণ নিলেও ঋণের বেশিরভাগ টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিবর্তে দেশের বাইরে পাচার, ভূমি ক্রয় ও ভোগ বিলাসে খরচ করেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। তার হাত ধরেই জনতা ব্যাংক থেকে সহজে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপ। তখন জামাল উদ্দিন জনতা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইভাবে সোনালী ব্যাংক লালদিঘী শাখার দায়িত্বে ছিলেন নোয়াখালীর দিলীপ দত্ত। যাকে কাজে লাগিয়ে বড় অংকের ঋণ হাতিয়ে নিয়েছে একই এলাকার মাকসুদুর রহমান।