বৃষ্টির অভাবে ফসলের চরম ক্ষতি, ভোগান্তিতে কৃষক
বর্তমান সময়ে এসে নানা ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে, বিশেষত কৃষি খাতে এ প্রভাব আরও অনেক বেশি দৃশ্যমান।
চলমান খরার কারণে ফসলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের অভাবে সেচকাজের অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। সব মিলিয়ে স্থবিরাবস্থায় আছেন দেশের কৃষকরা।
করোনা মহামারিতে খাদ্যের সংকট মোকাবেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতি বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ও গরম বাতাসের প্রবাহে (হিটশক) ৫৫ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেছে।
এই হিটশকের কারণে ৫৫ হাজার হেক্টরের মধ্যে ১৪-১৫ হাজার হেক্টর জমির ধান পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
গরম বাতাস প্রবাহের সময় বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেও যদি বৃষ্টি হতো তাহলে এই বিপুল পরিমাণ ধানের ক্ষতি হতো না বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল্লাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজমুল বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আক্রান্ত যেসব জমির ধান মাত্রই বের হচ্ছিল (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) অথবা ধানে চাল হচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ) সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধানগুলো পুরোপুরিই চিটা হয়ে যাবে। অথচ ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হলে এই ক্ষতিটা হতো না,"
তিনি বলেন, ফ্লাওয়ারিং স্টেজে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকা উচিত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু মার্চের শেষদিকে বিভিন্ন অঞ্চলে ধারাবাহিক তাপমাত্রা ছিল ৩৪-৩৫ ডিগ্রী বা কোথাও কোথাও তারও বেশি।
"অতিরিক্ত তামপাত্রায় ধানের পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু যদি এ সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতো তাহলে এই তাপমাত্রা অনেকটাই নেমে আসতো। এ কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ধানের পরাগায়নের কিছু অংশ বাধাগ্রস্ত হয়।"
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মার্চ-এপ্রিলে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে তা বোরোর উৎপাদন ব্যয় কমাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে তাপমাত্রা বেশি থাকলে তা ফলনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে।
সমতল ভূমিতে সেচ প্রক্রিয়ায় ফলনের প্রভাব সেভাবে নজরে না আসলেও প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে চরাঞ্চলের কৃষি জমিতে।
শুধু ধান নয়, কম বৃষ্টিপাতের কারণে ফলের উৎপাদন কমে আসা বলেও জানান র্কমর্কতারা।
অন্যদিকে, আউশের উৎপাদন পুরোপুরিই বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। সে সময় স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে ১০-১২ লাখ হেক্টরের আউশের আবাদে ফলন একেবারেই কমে যায়। আবার অতিবৃষ্টি এবং বন্যা হলে আউশের পাশাপাশি আমনের মৌসুমেও সংকট তৈরি হয় বলে জানা গেছে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নামজুল বারী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষির উৎপাদনকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে । স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে আমাদের কী ক্ষতি হয় বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত মার্চে শুধু সিলেট ও রংপুর বিভাগ ছাড়া সারাদেশের কোথাও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। পুরো বাংলাদেশের বৃষ্টিপাতের চিত্রে দেখা গেছে, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে।
জানা গেছে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের যে সম্ভাবনা ছিল তার চেয়ে ঢাকায় ৯২.৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৯৯.৬ শতাংশ, সিলেটে ১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৯৪.২ শতাংশ, রংপুরে ৪৬.৫ শতাংশ, খুলনায় ৯৪.৭ শতাংশ, বরিশালে ৯৯.৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।
প্রায় একই রকম অবস্থা ছিল গত বছরের মার্চে, তবে এপ্রিলে ভালো বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তবে ২০১৯ সালের মার্চ এপ্রিলে বৃষ্টিপাতের তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। গত মার্চ মাসে পশ্চিমা ও পূবালী লঘুচাপের প্রভাব কম থাকায় স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানা গেছে।
অথচ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতি বছর ১০-২৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় মার্চ-মে মাসের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবেই চলতি বছরের মার্চে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি।
বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয় বর্ষা মৌসুমে (জুন থেকে অক্টোবর)। এ সময়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি ছিল বলে জানা গেছে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি এপ্রিল মাসে দেশের প্রতিটি বিভাগে স্বাভাবিক বা এর চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, কম বৃষ্টিপাতের প্রভাবে চরাঞ্চলের বোরো উৎপাদনে সেচের খরচ দেড়-দুইগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। কারণ সেখানে খড়ার কারণে সেচও দিতে হয় বেশি।
শুধু বোরো নয়, গম, ভুট্টা, সবজির আবাদেও চরাঞ্চলে অনেক বেশি সেচ দিতে হয়। যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে সেচের খরচ অর্থাৎ উৎপাদন খরচও কমে আসে।
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ঘোড়জান ইউনিয়নের কৃষক লালবানু টিবিএসকে বলেন. "বৃষ্টি বেশি হলে সেচের খরচ কম হয়। বৃষ্টি না হলে বেশি সেচ দিতে হয়, খরচও পরে বেশি। আবার বেশি খড়ার মধ্যেও ফসল খারাপ হয়।"
সিরাজগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল হামিদ মিয়া টিবিএসকে বলেন, "চরের জমিতে বোরোর চাষ হয় সামান্য। গম, ভুট্টা, সড়িষা, সবজি, ফল সহ ডাল জাতীয় ফসলের চাষ বেশি হয়। এগুলোতে স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে সেচও কম দিতে হয়। তখন উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।"
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন খড়ার বড় প্রভাব পড়ে ফলের উৎপাদনে। প্রায় ৬০-৭০ ভাগ গ্রীষ্মকালীন ফলের উৎপাদন মৌসুম এটি।
এই সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে ফলের মুকুল ও ফল ঝড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কম বৃষ্টিপাতের কারণে ফলের আকার ছোট হয়ে যায় বলেও জানান তারা।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী টিবিএসকে বলেন, "অনাবৃষ্টির প্রভাব সেচ নির্ভর বোরো মৌসুমের ওপর খুব একটা প্র্রভাব ফেলে না। তবে বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচ কমে,"
তিনি আরও বলেন, "তবে ফলের ওপর অনাবৃষ্টির প্রভাব প্রকট। মুকুল ঝড়ে যাওয়া, অপরিপক্ক অবস্থায় ফল ঝড়ে পড়া এবং ফলের আকার ছোট হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালীন ফলের সবচেয়ে বড় যোগান আসে যে সময় তখন বৃষ্টি না হলে সামগ্রিক উৎপাদন বড় ধাক্কা খায়।"
বছরের এ সময় আম, কাঠাল, লিচু পেয়ারাসহ নানা ফলের বড় উৎপাদনের মৌসুম।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। কৃষিখাতে এর প্রভাব প্রকট।
ঝড়ের সময় বা ঝড়ের পরপরই স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এবার বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে হিটশকে ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের বড় উদাহরন বলে জানান তারা।