রানা প্লাজার সেদিনের স্মৃতি মনে করে আজও ডুকরে ওঠেন রেবেকা
''যেদিন রানা প্লাজায় ফাটল ধরে, সেদিন আমরা অফিসের ভিতরেই ছিলাম। আমি সেদিন দেখেছিলাম ভবনের বড় ফাঁটল ধরার অংশটুকু। সেদিন আমরা অনেকেই ছুটির জন্য অনুরোধ করলাম তাদের (রানা প্লাজা কর্তৃপক্ষ) কাছে। সেদিনের মতো ছুটি দিলেন; কিন্তু বলে দিলেন, পরের দিন আবার অফিসে আসার জন্য। আমিসহ অনেকেই তখন বলে ফেললাম, 'এত বড় ফাটল ধরেছে, যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়, তবে তো আমাদেরই ক্ষতি হবে।' চাকরি থাকবে না, টাকা দেওয়া হবে না, এমনি ভয় দেখিয়েছিল তারা। আবার অতিরিক্ত সময়ের কাজের টাকাটাও দেওয়ার কথা ছিল। তারপরেও আমরা অফিসে গেছি। কারণ আমরা গরিব মানুষ, মাস শেষে আমাদের খরচ আছে, ঘর ভাড়া দিতে হয়, খাওয়া খরচ আছে। সেদিন ৯টা বাজার এক মিনিট আগে আমার মা আমাকে খেতে ডাকে। কেননা আমি তো সকালে খেয়ে যেতে পারতাম না। তাই মা আমাকে প্রতিদিনিই খাইয়ে দেয়।'...
কথাগুলো বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেন রেবেকা খাতুন। অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে তার চোখ বেয়ে। চোখের পানি মুছে আবার বর্ণনা দেন সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে বহতল রানা প্লাজা ভবন ভেঙে পড়ার সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটির।
রেবেকা খাতুন সেই ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া 'রানা প্লাজা' ট্রাজেডির শিকার একজন পোশাক শ্রমিক। সেদিন প্রাণ হারান হাজারেরও বেশি মানুষ। আর যারা বেঁচে গেছেন, তাদের কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউ-বা পা, বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। রেবেকা খাতুনের দুই পা কেড়ে নিয়েছে সেই মর্মান্তিক ট্রাজেডি। এখন হাতে ভর দিয়ে কোনোমতে চলাচল করেন। সংসারের সবটা গোছাতে না পারলেও, কিছুটা করেন অনেক কষ্ট করেই। যেমনটা দেখা গেল তার বাড়িতে গিয়ে। বাসন মাজা, তরকারি কাটার পাশাপাশি কোনো রকমে রান্নার কাজটাও কষ্ট করে চালিয়ে নেন তিনি।
রেবেকা খাতুন দিনাজপুর ফুলবাড়ি উপজেলার ১নং এলুয়ারি ইউনিয়নের শিবনগর এলাকার বাসিন্দা। স্বামী, দুই ছেলে-মেয়েসহ চারজনের সংসার। তার মুখে উঠে আসে সেদিনের ভয়াবহ শিল্পদুর্ঘটনার স্মৃতি।
ছলছল চোখে তিনি বলতে থাকেন, ''তখন হাতে আমার এক পিচ কাজ বাকি ছিল। মা সেদিন বলল, 'আসো মা খাওয়ায় দিই তোমাকে।' আমি বললাম, 'আম্মা তুমি যাও, এক পিচ কাজ আছে শেষ করে যাচ্ছি।' আমার আম্মুও গেল, আর সাথে সাথে দুর্ঘটনাটি ঘটল। আর মায়ের সাথে খাওয়া হলো না। মায়ের আর লাশটিও খুঁজে পাইনি। ওই কারখানায় আমার পরিবারের ৭ জন কাজ করত। আমাকে দুই রাত দুই দিন পরে উদ্ধার করে। আমি তো বুঝতেই পারি নাই সেদিন কখন রাত, কখন দিন। আমার স্বামী এদিকে-সেদিক খুঁজে বেড়ায় আমাকে। আমি আর খোঁজ দিতে পারি না তাদের। আমার দু'টো পায়েই বিমের ভেতর ঢুকে ছিল। একটা পা পুরোটাই, আর আরেকটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। এক ছেলেকে বললাম 'ভাইয়া আমার দুই পায়ে ঢুকে গেছে, একটু বের করে দেন ভাই।' দুই রাত দুই দিন কিছু খাইনি। গায়ের ঘাম খাইছি, রক্ত চুষে খেয়েছি। সেই ছেলেকে বললাম, 'ভাই, একটু পানি দেন। আপনি আমার ধর্মের ভাই লাগেন, একটু বের করেন ভাই।' অনেক মানুষই আমার পা কেটে দিতে বলছিল। কিন্তু ওই ভাই, যে আমাকে বের করেছিলেন, তিনি কাটতে দেননি। সেই ভাই বলেছিলেন, 'আমাকে যেহেতু ভাই ডাকছে, যেভাবেই হোক আমার বোনটাকে জীবিত বের করব।' কিন্তু আমার পা ধরে যখন টান দিয়েছিল, তাতে করে পায়ের রগ ছিঁড়ে যায়। তাছাড়াও আমার ভিতরের একটি (মেয়েলি) সমস্যা হয় । আমার দু'পায়ে চার বার করে ৮ বার অপারেশন করেছে। খালি ইনফেকশন হয়ে যায় আর কাটে। আমি পা কাটতে চাইনি, কিন্তু উপায় কী? আমরা অপারেশনের সময় ৯০ ব্যাগ রক্ত লাগছে। বি-নেগেটিভ রক্ত শেষের এক ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ভালো থাক যারা আমাকে রক্ত দান করেছেন।"
এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার আজ ৮ বছর পূর্তি, কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি রেবেকার মনে। এখনো ভাবতে ভাবতে তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদেন। আর আঁতকে ওঠেন, আবার ভুলে যান অনেক কিছুই।
চোখের পানি মুছে আবার তিনি বলতে থাকেন, "আমরা আরও অপারেশন করত; বয়স কম, আবার হাড় বাড়তে পারে- তাই অপারেশন করেনি। ডাক্তার বলেছিল 'পরে অবস্থা বুঝে অপারেশন করব। হাড় বাড়লে তখন কাটা যাবে।' ১১ মাস ১৭ দিন থাকছি মেডিকেলে।"
বাচ্চাদের নিয়ে একটু খানি খেলতে চাইলেও বাধ সাধে তার পঙ্গুত্ব। অনেক মা তাকিয়ে দেখে থাকেন বাচ্চার বিদ্যালয়ে যাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তের দিকে। সেই সাধ আর পূর্ণ হবে না রেবেকার জীবনে। কাছেই বসে ছিল তার সাড়ে ৬ বছর বয়সী মেয়ে মুনতাহা।
এমনই কষ্টের বর্ণনাও দিয়েছেন রেবেকা বেগম। বর্ণনার সময়ে তার চোখের জল যেন বাঁধ ভাঙা নদীর বহমান স্রোতধারা। তিনি বলতে থাকেন, 'এখন অনেক কষ্ট হয়। বাচ্চা দুটো বাইরে গেলে, তাদের নিয়ে আসার মতো ক্ষমতা নাই। বড় মেয়ে বলে, '''আম্মু, সবারই মা স্কুলে (বাচ্চাকে) রাখতে যায়, তুমি আমাকে রাখতে যাও না কেন?' এটা শুনে খুব কষ্ট হয়; কষ্টগুলো বলার মতো না। দুটা বাচ্চাকে নিয়ে কিভাবে থাকি এখন! এই ঘটনায় আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। পা দুটো গেছে, পরিবারের সাতজনের মধ্যে আমি আর আমার ফুফু ফেরত এসেছি; বাকি ৫ জনের লাশেরও সন্ধান পাইনি।"
রেবেকা বেগমের স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান। দুজনই থাকতেন ঢাকায়। মোস্তাফিজ রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সেই সময়। যেদিন ঘটনাটি ঘটে, সেদিন তিনি রানা প্লাজার মোটামুটি কাছেই কাজ করছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে।
মোস্তাফিজ বলেন, "ঘটনাটি ঘটার পর যে যার মতো দৌড়ায় বেড়াচ্ছে। আমিও খোঁজা-খুঁজি করছি; পাই না। বড় ভাই শ্রীপুরে থাকতেন। ফোন করলাম। এসেই খুঁজতে লাগলেন তিনিও। অ্যাম্বুলেন্সের কাছে দৌড়া-দৌড়ি করি, এটাতে বুঝি আছে, এটাতে বুঝি আছে। কিন্তু নেই! তারপর দুইদিন পর আমার কাছে একটা কল আসে একজন স্কুল ছাত্রের। আমার নাম নিয়ে বলে, 'আপনি কি মোস্তাফিজুর? আপনার স্ত্রী সুস্থ আছে।' তার মাধ্যমে আমি আমার স্ত্রীর খোঁজ পাই। রেবেকার সাথে আরও একটা মেয়েকে পাওয়া গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু সে রেবেকার চেয়েও কম সিরিয়াস ছিল। কিন্তু সে মারা যায়। সেই মেয়ের লাশ মাঠে রেখে দিয়ে তারপর আমাদেরকে নিয়ে আসে অ্যাম্বুলেন্সটি। অক্সিজেন ছিল না, আমার স্ত্রী পাঙ্গাস মাছের মতো হাঁসফাঁস করছিল। তার জান যাচ্ছে, যাচ্ছে না...। অনেক অক্সিজেন চেয়েছিলাম সেদিন অনেকের কাছে, কে রাখে কার খোঁজ। আমাদের জন্য আর্মিরাও অনেক উপকার করেছে।"
পঙ্গুত্ব বরণ করেই দুই সন্তান প্রসব করেছেন রেবেকা বেগম। 'শ্রেষ্ঠ মনুষত্বের অধিকারী স্বামী মোস্তাফিজুর' বলে মন্তব্য তার। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। এমন পঙ্গু হলে অনেক স্বামী হয়তো ফেলে চলে যায়। কিন্তু উনি তা করেননি। বাড়ির কাজ করেন, আবার মানুষের বাড়িতেও কাজ করেন। উনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমার না আছে শাশুড়ি, না আছে মা। আমাকে উনি চাইলেই হয়তো ছেড়ে দিতে পারতেন। তা করেননি, বরং এখনো সেবা-যত্ন করেন।'
মোস্তাফিজুর বলেন, 'আমি কখনো আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তাই করিনি। আমি ভাবি- এমন ঘটনা আমার বোনের সাথেও হতে পারত। কিংবা আমার সাথেও হতে পারত। আমার বোনকে যদি তার স্বামী ছেড়ে দিত, আমার কেমন লাগত?'
এখন অনেকটা কষ্ট করেই দিনাতিপাত করেন রেবেকা বেগম। বাসন মাজা, তরকারি কাটা, রান্না করার কাজটাও চালান তিনি এই অবস্থাতেই। তার মতো অনেকের জীবনেই হয়তো চলছে অনেক কষ্টে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে যারা দুই অঙ্গ হারিয়েছেন, তারা পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। আর যারা ডান দিকের একটি অঙ্গ হারিয়েছেন, তারা পেয়েছেন ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা এবং বাম দিকের একটি অঙ্গ হারানোরা পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। তবে দুই অঙ্গ হারিয়েও রেবেকা বেগম পেয়েছেন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়ী বীমা। এর কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, বিজিএমই'র সহায়তায় এই বীমা পেয়েছেন। কিন্তু তথ্য নেওয়ার সময় বিজিএমই'র লোকজন একটু ভুল করেছিলেন। তাদের কাগজপত্রে লিখেছিলেন, রেবেকার শুধু বাম পা কাটা। তাই এই ঘটনায় ১০ লাখ টাকা সঞ্চয় বীমা পান তিনি। তার ভাগ্যে এখনো বাকি ৫ লাখ টাকা জোটেনি।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, 'ওই নারীকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে একটি গৃহ প্রদান করা হচ্ছে। আর তিনি যে বাকি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাননি, তা প্রদানের জন্য বিজিএমইকে জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেহেতু আমি নতুন এসেছি, তাই বিষয়টি জানতাম না। জানলে আগেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করতাম।'