ঘুরে দাঁড়াতে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ চায় ফুল ব্যবসায়ীরা
- দেশে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ফুলের মার্কেট
- ক্ষতির সম্মুখীন এ খাতে কর্মরত ২০ লাখ লোক
- নষ্ট হয়েছে অবিক্রিত ১৩০০ কোটি টাকার ফুল
করোনার কারণে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান অয়োজন। অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফুল বিক্রি করতে না পেরে লোকসানে ফুল ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা।
তারা জানায়, করোনাভাইরাস মহামারীর প্রথম ধাক্কার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ধাক্কা এসে পড়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখন ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ চায় তারা।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির তথ্য মতে, দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ফুলের বাজার। কিন্তু গত বছর মার্চে দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ফুল বিক্রিতে ধস নামে। কৃষকের ক্ষেতেই পচতে থাকে ফুল। কোথাও ফুল হয়ে উঠে গরুর আহার।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সামনে লক ডাউন উঠে গেলেও সামাজিক অনুষ্ঠানের বিধিনিষেধ তো দ্রুত উঠবে না । অনুষ্ঠান না হলে ফুল বিক্রি হবে না। আমাদের ফুল বিক্রি সামাজিক অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। বেঁচা-কেনা নেই, আমরা একটা দুর্বিষহ অবস্থায় আছি'।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে সারা দেশে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে বলে জানান ইমামুল হোসেন । তিনি বলেন, 'গত বছর মার্চ থেকে এই বছর মার্চ পর্যন্ত তেমন কোন অনুষ্ঠান হয়নি । যেখানে আমাদের এ সময়ও ফুল বিক্রির লক্ষ্য ছিল এক হাজার ৫০০ কোটির বেশি। সেখানে আমাদের সর্বোচ্চ ২৫০ কোটি টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। ১৩০০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়ে গেছে'।
করোনার কারণে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ফুল বিক্রি আগের মত হবে না বলেই মনে করেন ইমামুল হোসেন । তিনি বলেন, ফুল চাষি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন ৪ শতাংশ হারে ব্যাংক ঋণ । এতে তারা কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।
রবিবার শাহবাগ ফুলের মার্কেটে গিয়ে দেখা যায় তিন চারটি ফুলের দোকান খোলা। কেউ একজন পাশ দিয়ে হেটে গেলেই বলা হচ্ছে 'ভাই ফুল কিনবেন?'। 'ফুলতলা ফ্লাওয়ার শপে'র বিক্রয় কর্মী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'যে লোকসানে আছি এটা বলে বুঝানো যাবে না। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য দোকান খোলা রাখা হয়েছে । মানুষ জানুক এখনো ফুল বিক্রি হয়'।
শাহবাগ বটতলার ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনুষ্ঠান হয় না তাই ফুল বিক্রিও নেই। ৫১টি ফুলের দোকানে গড়ে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার বিক্রি হতো। এখন দোকানের মালিক-কর্মীরা বেকার। কবে এই দুর্ভোগ কাটবে জানা নেই'।
কথা হয় শান্তা পুস্প বিতানের মালিক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের দোকান বন্ধ রেখেছি। বিক্রি নেই দোকান খুলে কি করব'।
ফুল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংকটময় এই পরিস্থিতিতে কর্মচারী, দোকান ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় সরকারের বিশেষ সহযোগিতা ছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।
ফুল ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর তথ্যমতে, দেশের প্রায় ২৩ জেলায় ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার সাভার। রজনীগন্ধা , গাঁদা , গোলাপ, গ্লাডিওলাস , জারবেরা ফুল এখন বেশি চাষ হয়।
১৯৮৬ সাল থেকে ফুল চাষ করেন আব্দুল খালেক। সাভারে জমি লিজ নিয়ে ফুল চাষ করছেন তিনি। কর্মচারী রেখেছেন ১৫ থেকে ১৬ জন।
তিনি বলেন, 'জমানো টাকা একপ্রকার শেষ করেই ফেলেছি। তারপরেও কোন কর্মচারী ছাঁটাই করি নি। এত দিন ধরে ফুল চাষ করি তাই এর সঙ্গে আবেগ জড়িত'।
আব্দুল খালেক বলেন, 'জমি লিজ নিয়ে ফুল চাষ করি। ব্যাংকের কাছে ঋণ চাইলে বলে, আপনার তো নিজের জমি নাই কিসের ভিক্তিতে ঋণ দিব। আমরা যেন সহজে ঋণ পাই সে ব্যবস্থা করা হোক'।
ফুল চাষে খরচ
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন বলেন, 'ফুল চাষে খরচ অনেক। এক একর জমিতে রজনীগন্ধা ও গাঁদা চাষ করলে দুই থেকে তিন লাখ খরচ হবে। সেখানে গোলাপ চাষ করলে সাত থেকে আট লাখ টাকা লাগবে।পলি সেড দিয়ে চাষ করলে এক বিঘা জমিতে ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। জারবেরা চাষে খরচ আরও বেশি'।
ক্ষতির সম্মুখিন এ খাতে কর্মরত ২০ লাখ লোক
ইমামুল হোসেন বলেন, ফুল চাষের আয়ের উপর সারাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। তারা এখন কষ্টে আছে। ফুলচাষি, শ্রমিক থেকে শুরু করে যারা ফুলের প্যাকেজিংয়ে জড়িত সবাই সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি বলেন, 'চাষিরা অনেক বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত। গতবার আমরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৪ শতাংশ সুদের ঋণ পাওয়ার জন্য বলেছিলাম । এখনও সে ব্যাংক ঋণ পাই নি। আমাদের সবার অবস্থা করুণ। সরকারের প্রতি চাওয়া, চাষিদের ত্রান সহায়তা বা খাদ্য সহায়তা যেন দেয়া হয়। আমাদের ফুল চাষিদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে । আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ । আমরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারি, আবার আগের অবস্থায় যেতে পারি তার জন্যএই ঋণ খুবই জরুরি'।
শেরেবাংলা নগর ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সেক্রেটারি মো. খোরসেদ আলম বলেন, 'আগারগাঁওয়ে ১০০'র বেশি দোকান আছে। এখন ১৫টির মতো খোলা। ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন। গতবছর সরকার থেকে বলা হয়েছিল, যারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও চাষি আছে তাদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে। কিন্ত সে ঋণ এখনও পাই নি। এখন এমন অবস্থা হয়েছে ঋণ না পেলে ব্যবসা ধরে রাখা কঠিন হবে'।
তিনি বলেন, 'ফুল একপ্রকার কৃষি পণ্য।এটি কাঁচা ও পচনশীল। এটাকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা উচিত যাতে ব্যবসায়ীদের ফুল পরিবহনে কোন ঝামেলা না হয়'।