আমিরাতের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া দার্শনিক হ্যাবারমাসকে কতটুকু চেনেন?
বিশ্বের সমকালীন জীবিত দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী একজন জার্মান দার্শনিক ইয়রগেন হ্যাবারমাস আগামী মাসে ৯২ বছরে পা দেবেন। গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি বিতর্কিত পুরস্কার গ্রহণ করে পরে আবার সেই পুরষ্কার বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
২০২১ সালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উপাধি দেওয়া 'শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড' পুরষ্কারের অঙ্ক ছিল ২২৫,০০০ ইউরো। উপসাগরীয় অঞ্চলের এ দেশটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে হ্যাবারমাস পুরষ্কারটি বর্জন করেন।
শেষ পর্যন্ত গত সাত দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত তার নিজের দার্শনিক নীতিবোধের সঙ্গে আপোস করেননি তিনি।
২০১৫ সালে শরণার্থি সংকটের সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকারের পক্ষে ও ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদ ও জেনোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তিনি।
মুক্ত গণতন্ত্রের বিশ্বজনীন ধারণার প্রতি সবসময়ই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ৯০ বছরে পা দেওয়ার পর তিনি ১৭০০ পৃষ্ঠার তিন খণ্ডের 'দিস ঠু আ হিস্ট্রি অব ফিলসফি' নামক পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করেন তিনি।
নীপিড়নের দায়ে অভিযুক্ত এই রাজতন্ত্রের পুরষ্কার গ্রহণকে বাকস্বাধীনতা ও জনপরিসরে উন্মুক্ত বিতর্কের তার নিজস্ব যে ধারণা রয়েছে তার পরিপন্থী মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
স্পাইগেল অনলাইনকে দেওয়া এক বিবৃতিতে হ্যাবারমাস স্বীকার করেছেন যে প্রাথমিকভাবে পুরষ্কারটি গ্রহণ তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
জনপরিসর তত্ত্বের প্রবর্তন
১৯২৯ সালে ডাসেলডর্ফে জন্মগ্রহণ করলেও ইয়রগেন হ্যাবারমাসের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে ফ্রাঙ্কফুটে। বলা যায় ফ্রাঙ্কফুট নয় বরং ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুলেই তার বিচরণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
১৯৬৪ সালে বন থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর ইউনিভার্সিটি অব ফ্র্যাঙ্কফুটের দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের চেয়ারপার্সন হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
১৯৮৯ সালে 'দ্য স্ট্রাকচারাল ট্রানসফরমেশন অব দ্য পাবলিক স্ফিয়ার' শিরোনামে তার পোস্ট-ডক্টরিয়াল গবেষণা প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ গবেষণা প্রবন্ধেই তার 'জনপরিসর' ধারণা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। এ প্রবন্ধে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, ১৭ ও ১৮ শতকের ইউরোপের সেলুন, কফিশপ মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র ছিল। এসব জনপরিসরে অবাধে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা আলোচনা হয়েছে, সংবাদপত্রে পক্ষে-বিপক্ষে লেখা হয়েছে। এ সব কিছুই বুর্জোয়া মতাদর্শ বিকাশে সহায়ক ছিল।
তিনি মার্ক্সিয় তত্ত্বের যে আধুনিকায়ন করেছিলেন, ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। তবে ঠিকই সেই আন্দোলন আরও উগ্র হয়ে ওঠায় তার সমালোচনাও করেন তিনি।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত তার অন্যতম প্রধান কাজ 'থিওরি অব কমিউনিকেটিভ অ্যাকশন' বইয়ে তিনি আধুনিক সমাজের জন্য নির্দেশনা দেন। ভাষা ও যুক্তিবাদী তর্ক কীভাবে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্য গণতান্ত্রিক আলোচনায় মুক্তভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয় তা নিয়ে বইটিতে আলোকপাত করেন তিনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিতর্কিত মানবাধিকারের রেকর্ড
হেবারমাসের গণতান্ত্রিক আলোচনার যে তত্ত্ব, হরহামেশাই তার অন্যথা লক্ষ করা যায় আমিরাতে।
আমিরাত নিজেদের উদারনীতিবাদের ঘাঁটি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেও দেশটির বাস্তব দৃশ্যপট একেবারেই অন্য কথা বলছে। সমালোচনাকারীদের কারাদণ্ড দেওয়া, অভিবাসী শ্রমিকদের সীমাবদ্ধ অধিকার ও মানবেতর জীবন যাপন ও দুবাইয়ের শাসকের নিজ কন্যাকে জোরপূর্বক বন্দী করে রাখা- মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে আমিরাতে।
২০১৮ সালে নৌকায় করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আমিরাতের রাজকন্যা লতিফা। সম্প্রতি তিনি গোপনে বন্ধুদের কিছু ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, তার বাবা দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল মাকতুমই তাকে 'বন্দী' করে রেখেছেন। নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি তার একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে #ফ্রিলতিফা ক্যাম্পেইন শুরু হয়। এর আগে, ২০০০ সালে লতিফার বোন শামসাকে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ থেকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তাকে কখনো জনসম্মুখে দেখা যায়নি।
হে হ্যাবারমাস আমিরাতের পুরস্কার বর্জনের আগের দিন কেনটাকি ডারবি থেকে শেখ মোহাম্মদের ঘোড়া নিষিদ্ধের দাবি তোলে ফ্রিলতিফা ক্যাম্পেইন।
আমিরাতের কর্তৃত্ববাদী সরকারের উদারনৈতিক ও সহনশীল উপরি আচরণের পেছনে নারী অধিকার সম্পর্কিত প্রশ্নে তাদের বিপরীত আচরণের চিত্রই সাধারণ হয়ে উঠেছে। এরমধ্যেই মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে এ পুরস্কার বর্জন করেন তিনি।
দুবাইয়ের সেলিব্রিটি ইনফ্লুয়েন্সারদের বিশ্ববাসীর কাছে দুবাইয়ের সাম্প্রতিক সময়ের চাকচিক্যময় শিল্প-সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য করমুক্ত আয়ের সুবিধা দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, 'সহনশীলতার মূল্য', প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই 'শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড' দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রাথমিকভাবে পুরষ্কার গ্রহণ
হ্যাবারমাস আশা করেছিলেন পুরষ্কারটি বাকস্বাসধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রচারে ভূমিকা রাখবে।
হ্যাবারমাস প্রাথমিকভাবে পুরস্কারটি গ্রহণের পর স্পাইগেল অনলাইন প্রশ্ন করেছিল, সারাজীবন মুক্তিবুদ্ধির চর্চা করা এ দার্শনিক কেনো সরাসরি পুরস্কারটি বর্জন করেননি। হ্যাবারমাস প্রথমে বলেছিলেন, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শের প্রচার করে- দেশটিতে তার বইসহ এমনই অন্যান্য বই ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ দিবে এই অ্যাওয়ার্ড; এমন চিন্তা থেকেই তিনি প্রাথমিকভাবে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়রগেন বুজের সঙ্গে তিনি এ নিয়ে শলা পরামর্শ করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
বুজ পরবর্তী সময়ে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, হ্যাবারমাসের পুরস্কার বর্জন তাইকে হতাশ করেছে।
"আমি অবশ্যই তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। কিন্তু, এ পুরস্কারের মাধ্যমে তিনি আরব দেশগুলোতে তার গুরূত্বপূর্ণ কাজগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পেতেন। এখন পর্যন্ত বেশ কিছু সংখ্যক জার্মান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর কাজ আরবিতে অনূদিত হয়েছে,"
মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে পুরষ্কার বর্জন
হ্যাবারমাস পুরস্কার বর্জনের ঘোষণার দেওয়ার পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেন, হ্যাবারমাস তার 'জনপরিসর' ধারণার উদ্দীপনা ধরে রেখেছেন, নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে আপোস করেননি।
স্বতন্ত্র অ্যাক্টিভিস্ট লিন্ডন পিটারসন টুইটারে লিখেছেন, "জনপরিসরের ধারণা দেওয়া হ্যাবারমাস আমিরাতের পুরস্কার বর্জন করেছেন দেখে ভালো লাগছে। আমিরাতে গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা না থাকায় এখানে কোনো জনপরিসরও নেই।"
সেইসঙ্গে আমিরাত সরকারের সমালোচনা করে কারাদণ্ড প্রাপ্ত অ্যাক্টিভিস্ট আহমেদ মনসুরের মুক্তির দাবিকে জোরালো করার আহ্বান জানান তিনি।
নাৎসি শাসনামলে প্রত্যক্ষ করায় হ্যাবারমাস তার লেখনীর মাধ্যমে ইউরোপ ও পুরো বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রচারের কাজ করে গেছেন। তাদের কাজের অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল কীভাবে ভবিষ্যতে হলোকাস্টের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যায়। একটি সমাজের সদস্যদের নিজেদের স্বার্থ নির্ধারণের জন্য সহায়ক বেশ কিছু জটিল যোগাযোগ মডেল তৈরি করেছেন তিনি।
এসব সামাজিক মডেলের নাম দেওয়া হয়েছে 'কনসেনশুয়াল', ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির সার্বিক প্রেক্ষাপটে এ নামের বেশ ব্যতিক্রমী প্রভাবও পড়ে। দেশটির নাগরিকরা উপর মহলের আদেশ পালনের পরিবর্তে নিজেরা সর্বস্তরে অংশগ্রহণ শুরু করেন। স্বাধীনভাবে জনপরিসরে নিজেদের মত প্রকাশের মাধ্যমে ও বড় পরিসরে তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে দেশটিতে।
- সূত্র: ডয়েচে ভেলে