চট্টগ্রামে কৃষি ব্যাংকের সন্দেহজনক সুদ মওকুফ
চট্টগ্রামে বিএনপির এক নেতাকে ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের অভিযোগ উঠেছে কৃষি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ২০১১ সালে মাত্র ৬ কোটি টাকার জমি বন্ধক দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৮৫ কোটি টাকার ঋণ নেন এই নেতা। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক এবং কর্ণফুলী থানার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আলী আব্বাস।
আব্বাস নিজকে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে মেসার্স আব্বাস ট্রেডিংয়ের নামে এই ঋণ নেয়। ব্যাংকের ঋণে ব্যবসা করলে যথাসময়ে তা শোধ না করায় তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাংক ২০১৩ সালে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে। একই বছর এই ঋণের টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আট বছর আগে দায়ের করা এই দুই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আব্বাস ট্রেডিংকে ৪৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছে কৃষি ব্যাংক।
এই অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আব্বাস ট্রেডিংয়ের সুদ মওকুফের বিষয়ে ২০২০ সালে একটি অভিযোগ জমা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্স ইনটেলিজেন্স ইউনিট। অনুসন্ধানে অনিয়মের মাধ্যমে ৪৮ কোটি টাকা মওকুফের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন অনুসারে, কৃষি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-৫ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তাকে সুদ মওকুফ করে দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্স ইনটেলিজেন্স ইউনিটের গত মার্চ মাসের প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে 'আব্বাস ট্রেডিংকে নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিবেচনার সুযোগ নেই'।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্স ইনটেলিজেন্স ইউনিটের হেড আবু হেনা রাজি বলেন, 'আব্বাস ট্রেডিংয়ের ঋণে অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। যেহেতু এই বিষয়ে দুদক মামলা দায়ের করেছে তাই দুদক ব্যবস্থা নিবে'।
২০১০ সালের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ব্যবসা শুরু করে মেসার্স আব্বাস ট্রেডিং। ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়ের সুপারিশে ২০১১ সালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় মেসার্স আব্বাস ট্রেডিংয়ের নামে শর্ত সাপেক্ষে ৮৫ কোটি টাকার ঋণ দেয়।
ঋণ মঞ্জুরীর শর্তে ভবনসহ ৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার জমি বন্ধক দেয়ার কথা থাকলেও আব্বাস প্রতারণা করে ভিন্ন দামে মাত্র ছয় কোটি টাকা মূল্যমানের ৩ দশমিক ৭৫৫ একর জমি বন্ধক দেয়। এমনকি সহায়ক জামানত হিসেবে ৫ কোটি টাকার এফডিআর রাখার কথা থাকলেও তা মানা হয় নি।
ঋণ পুনঃতফসিলের সময় অর্থাৎ ২০১৯ সালে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নোটিংয়ে ব্যাংকের নিকট বন্ধককৃত নাল জমির প্রকৃত মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ছয় কোটি ১৪ লাখ টাকা। এটা ঋণের শর্ত পরিপন্থি।
এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ৩০ জুন আব্বাস মেম্বার ঋণের সুদ মওকুফের আবেদন করলে কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় কর্তৃক গ্রাহকের ঋণ স্থিতির হিসাবপূর্বক বিআরপিডি সার্কুলার-৫ এর আওতায় সুদ মওকুফের জন্য ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৭৪০ তম সভায় কার্যপত্র উপস্থাপিত হয়। সভায় আরোপিত সুদের ১০০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৯ কোটি ৭৭ লাখ ৫৬ হাজার ও স্থগিত খাতের সুদ ৪১ লাখ ৪২ হাজারের অর্ধেক ২০ লাখ ৬২ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ৪৭ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা সুদ মওকূপ করা হয়। অবশিষ্ট পাওনা ৯ শতাংশ সুদে দশ বছরে মোট ৩৬টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক শাহাদত হোসাইন বলেন, 'ব্যাংকের টাকা শোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল। তবে ঋণটি ইতোমধ্যে পুনঃতফসিল করা হয়েছে।' তবে শর্ত ভঙ্গ করে ঋণ নেয়ার পরও কেন গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি শাখায় নতুন দায়িত্ব নিয়েছে। এই বিষয়ে আমি অবগত নই।
মেসার্স আব্বাস ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী আব্বাস বলেন, 'ঋণ পুনঃতফসিল হওয়ার পর ইতোমধ্যে দুই কিস্তি টাকা পরিশোধ করেছি। পুনঃতফসিলের শর্তানুযায়ী বাকি টাকাও শোধ করা হবে'।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক বলেন, '৪৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ কিভাবে হলো, সেটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তবে দুদকের মামলা চলবে এবং মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় দোষী ব্যক্তিকে অবশ্যই আইনগত শাস্তি ভোগ করতে হবে।'