ভালো শুরুর পরেও হোঁচট খেল কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি
মহামারি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো ভ্যাকসিন। যেসব দেশে একসঙ্গে অধিক মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে তাদের সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে এবং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি খুব ভালোভাবে শুরু হলেও এখন তা একেবারে পিছিয়ে পড়েছে। সংকটের কারণে আগামীতে টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তীব্র হচ্ছে। এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনায় এরইমধ্যে অনেক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইসরায়েল। বাইরে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে দেশটি। অনেক দিন বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।
৫৩ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ ও ২৬ শতাংশ মানুষকে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পর যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আত্রান্ত ও মৃত্যু একেবারে কমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও নতুন রোগী ও মৃত্যু কমছে ভ্যাকসিনের প্রভাবে।
তবে যেসব দেশে কম মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে সেসব দেশে সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন করে লকডাউন বা অন্যান্য বিধিনিষেধ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার পিছিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩.৬ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন আর প্রথম ডোজ পেয়েছেন ২ শতাংশ মানুষ। এরই মধ্যে ঈদের পর সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সংক্রমণ রোধে লকডাউনের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশে কোভিড পরিস্থিতি দীর্ঘ হচ্ছে শুধু।
মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, 'ঘরমুখী মানুষের ভিড় ও মার্কেটে জনসমাগম যেভাবে বাড়ছে তাতে দ্বিতীয় ওয়েভ না যেতে যেতে তৃতীয় ওয়েভ আসবে। তারপর কোরবানির ঈদের সময় সংক্রমণ বাড়বে। এভাবে চলতে থাকলে সংক্রমণ কমবে না'।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে ভ্যাকসিন দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা কঠিন হবে। ভ্যাকসিন দিয়ে আমাদের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে হবে। হার্ড ইমিউনিটির জন্য দ্রুত ১২ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে, সেজন্য ২৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একটি উৎসের ওপর নির্ভর করে মাত্র দেড় কোটি মানুষের জন্য আমরা ভ্যাকসিন জোগাড় করেছিলাম। সেই ভ্যাকসিনও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা যদি শুরু থেকে পঞ্চাশোর্ধ ও রেড জোনের মানুষকে ভ্যাকসিন দিতাম তাহলে মৃত্যু অনেক কমে যেতো। এখন চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা চলছে কিন্তু তাতে অনেক সময় লেগে যাবে'।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, 'বাংলাদেশকে এখন নিজে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও গবেষণায় অংশ নিয়ে প্যাটেন্টের অংশ হতে হবে। প্রতি বছর ২৪ কোটি ডোজ করে মিউটেন্ট ভ্যাকসিন কেনা কঠিন হয়ে যাবে। ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য বিরাট বিনিয়োগ করতে হবে তা না হলে জীবন ও অর্থনীতি বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে'।
শুরুতে দিনে দেড় লাখের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হলেও ভ্যাকসিন সংকটের কারণে ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। এখন দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার জন্য ভ্যাকসিন হাতে আছে মাত্র ৮ লাখ ডোজ। প্রথম ডোজ দেয়া প্রায় ১৫ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ নেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
তবে বুধবার চীনের উপহারের ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আসবে। রেজিস্ট্রেশনের পরও যারা করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ পাননি তাদের চীনের টিকা দেওয়া হবে। তবে চীনের কেনা ভ্যাকসিন কবে পাওয়া যাবে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
চীন থেকে চার-পাঁচ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে চায় সরকার
চীনের কাছ থেকে চার বা পাঁচ কোটি ডোজ কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন কিনতে চায় সরকার। এটি নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নেপালকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী উপহার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান।
মন্ত্রী বলেন, 'আমরা টিকার জন্য চীনের কাছে 'লেটার অব ডিমান্ড' পাঠিয়েছি। এরপর তারা 'নন-ডিসক্লোজার ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে, যা দেখে আমরা স্বাক্ষর করব। এরপরই চূড়ান্ত চুক্তি হবে'।
বাংলাদেশ অনুমোদন না দেওয়ার কারণে চীনের টিকা আসতে দেরি হয়েছে বলে সোমবার এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'চীন আমাদের দেশে ট্রায়াল করতে চেয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা ট্রায়ালের জন্য অর্থ চাওয়ায় আমরা রাজি হইনি। এখন আমরা তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনতে চাচ্ছি। দুটি চুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। একটি সরাসরি ক্রয় করা এবং আরেকটি এখানে উৎপাদন করার'।
বাণিজ্যিকভাবে চীনের টিকা কবে নাগাদ আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমন নয় যে এটি শুধু ডিসেম্বরেই আসবে। আমরা প্রস্তাব করেছি জুন-জুলাই থেকে আমাদের টিকা দেওয়ার জন্য। তাদের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা ধীরে ধীরে টিকার চালান পাবো। তারা রাজি হয়েছে যে জুন-জুলাই মাস থেকে তারা কিছু টিকা দেবে'।
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'তাদের ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিপত্র রয়েছে। সেটি যাচাই-বাছাই করে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। তাদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছি। রাশিয়ার সঙ্গে ইতোমধ্যে আমরা নন-ডিসক্লোজার চুক্তি সই করেছি এবং এই চুক্তি সই হওয়ার পরে আমরা সংগ্রহ ও যৌথ উৎপাদন বিষয়ে আলোচনা শুরু করবো'।
ভারতের সঙ্গেও পাওনা টিকার জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।
দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য ভ্যাকসিন নেয়া যাবে কি
ভারত থেকে টিকা আসা নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রথম ডোজ পাওয়াদের দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অন্য ভ্যাকসিন দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, 'এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে টিকাদান সংক্রান্ত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিসমূহ কাজ করছে। তারা এখনো কোন সিদ্ধান্ত জানায় নি'।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, 'যারা প্রথম ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে কোন ডাটা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঊদ্বৃত্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রয়েছে। এখনো তিন মাস সময় আছে; আমার বিশ্বাস সরকার কূটনৈতিক সক্ষমতায় ১৫-২০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আনতে পারবে'।
তিনি বলেন, 'তিন মাসের মধ্যে যদি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন পাওয়া না যায় তাহলে প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন দেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ মর্ডানা ও ফাইজারের ভ্যাকসিন দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। গবেষণার ফলাফল পেলে তখন এই দুটি ভ্যাকসিন দেয়া যাবে। এসব ভ্যাকসিনও না পাওয়া গেলে তখন দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে সিনোফার্ম বা স্পুটনিক দেয়া যেতে পারে একেবারে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে'।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, 'অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনই দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা'।