নার্সিং পেশাকে গুরুত্বদান যেভাবে করোনা মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে
আজ ১২ মে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস। ১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক নার্সেস কাউন্সিল (আইসিএন) এ দিনটি ঘোষণা করে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর দিবসটি এ দিনে পালিত হচ্ছে।
'Nurse A Voice To Lead : Vission For Future Health Care'- এটি আইসিএন কর্তৃক এবারের আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবসের থিম বা মূল প্রতিপাদ্য। বাংলা করলে দাঁড়ায় 'নার্সেস: এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে ভবিষ্যত স্বাস্থ্য খাতে একটি দর্শন'। এ বছর নার্সেস দিবসের সাব-থিমও এটিই- 'ভিশন ফর ফিউচার হেলথ কেয়ার'।
এ প্রসঙ্গে আইসিএন সভাপতি অ্যানেট কেনেডি বলেছেন, " কোভিড -১৯ মহামারি দেখিয়েছে বিশ্বজুড়ে নার্সরা মানুষকে আজীবন সুস্থ রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।"
যদিও স্বাস্থ্যসেবা উল্লেখযোগ্য ব্যাহত হয়েছে, তবুও উল্লেখযোগ্য নতুনত্ব এসেছে এ খাতে। যা উন্নত করেছে আমাদের সেবা প্রদানের পদ্ধতিকে। ২০২১ সালে, আমরা নার্সিংয়ের পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনের উপর মনোনিবেশ করব এবং কীভাবে এটি চূড়ান্তভাবে স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যতের রূপ দেবে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব।
তবে এটি সত্যি যে, মহামারিটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলোর দুর্বলতা এবং আমাদের নার্সরা যে বিপুল চাপের মধ্যে কাজ করছে সেগুলো উন্মোচিত করেছে, পাশাপাশি তাদের অবিশ্বাস্য প্রতিশ্রুতি ও সাহসের বিষয়ে আলোকপাত করেছে।
মহামারি আমাদের স্বাস্থ্য সেবার মূল কেন্দ্রে যে নার্সরা থাকে সেটি বুঝিয়ে দিয়েছে।
রোগীর দৈনিক সেবার প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি কাজ নার্সরা করেন। গেল বছর স্বাস্থ্য দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ লাখ নার্সের প্রয়োজন হবে।
বর্তমান বিশ্বে মোট স্বাস্থ্যকর্মীর অর্ধেক নার্স। তবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় নার্সের সংখ্যা নগণ্য; প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ১.৭৫ জন নার্স কাজ করেন। বাংলাদেশে প্রায় ২.৫ লাখ নার্সের প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার জনের বিপরীতে ০.৬৩ জন ডাক্তার আর প্রতি ৪ হাজার ০.৮১ জনের বিপরীতে মাত্র একজন নার্স রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মোতাবেক ডাক্তার ও নার্স অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩। কিন্তু একজন ডাক্তারের বিপরীতে রয়েছে ০.৫৬ জন নার্স। যার কারণে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানের চিত্র অতি করুণ।
সরকার গেল করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে ৫০৫৪ জন নার্স এবং শীঘ্রই আরো ২৫০০ জন নার্স নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে বর্তমানে সরকারি চাকুরীরত নার্সের সংখ্যা ৩৬৭৮৫ জন (সূত্রঃ ডিজিএনএম)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ দেশেই প্রতি ১ হাজার লোকের জন্য রয়েছে মাত্র ৪ জন বা তার চেয়ে কমসংখ্যক নার্স। নার্স ঘনত্বের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ফিনল্যান্ড, ১ হাজার লোকের জন্য ১৭ জন এবং তারপরেই ১৪ জন নিয়ে আয়ারল্যান্ড । অন্যদিকে সবচেয়ে কম নার্সসম্পন্ন প্রথম পাঁচটি দেশ আফ্রিকায়। বাংলাদেশের অবস্থান ছয় নম্বরে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ডাক্তার-নার্স-হেলথ টেকনিশিয়ানের অনুপাত ১:৩:৫ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে ১:০.৫:০.২৫। নার্স, হেলথ টেকনিশিয়ান ও মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট জাতীয় স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতার পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বীকৃতি, আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদার অবস্থাও খুব খারাপ। অথচ একজন রোগীর হাসপাতালে অবস্থানের সময়ের একশ ভাগের এক ভাগ সময় মাত্র ডাক্তারের সেবা প্রয়োজন হয়, বাকি সময় প্রয়োজন হয় নার্স ও মেডিকেল অ্যাটেনডেন্টের সেবা।
করোনার ফলে স্বাস্থ্যখাতে বিশাল প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ভারতে বাংলাদেশিরা ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৪২,৫০০ কোটি টাকা চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করেছে।
করোনার কারণে এই রোগীরা এখন দেশেই চিকিৎসা নিবেন। ফলে ৪২,৫০০ কোটি টাকা দেশে থেকে যাবে, যা ব্যয় হবে নতুন হাসপাতাল তৈরি ও কর্মসংস্থানে। বর্ধিত রোগীকে দেশে চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য আমাদের অল্পদিনে প্রচুর সংখ্যক নার্স ও মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট তৈরি করতে হবে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে।দেশের বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে তবেই মানসম্মত নার্স তৈরী হবে।করোনা একদিকে যেমন আমাদের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছে তেমনি এ খাতে একটা বড় রকমের প্রবৃদ্ধির সুযোগও তৈরি করেছে। করোনার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে ডাক্তারদের বাইরে যে বিশাল একটি জনবল সম্পৃক্ত রয়েছে, তাদের প্রতি আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিইনি।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের অনেক উন্নতি হয়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু গড় আয়। বর্তমানে এদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩.৪ বছর। অপর দিকে থাইল্যান্ড ও জাপানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৭৫ এবং ৮৪ বছর। ১৮ কোটির জনসংখ্যার এই দেশ ২০৫০ সালে ২৫ কোটিতে উপনীত হবে। ধীরে ধীরে এ দেশে বয়স্ক মানুষের আধিক্য ঘটবে এবং আমরা উন্নত বিশ্বের ন্যায় বয়স্কমানুষজনিত সমস্যায় উপনীত হব। তাই তাদের চিকিৎসা ও সেবার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রয়োজন হবে এক বিশাল দক্ষ কর্মীবাহিনী/ নার্স। কিন্তু বাংলাদেশে দক্ষ নার্স তৈরির সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমরা অদ্যাবধি প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য সংখ্যক নার্স তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।
আমরা কেবলমাত্র নতুন নীতি তৈরি করে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবার এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারি।
আগামী বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার সমুদ্রসম চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাই সবদিক বিবেচনায় এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবায় নার্সকে অনন্য দর্শন বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং নার্সিং পেশায় কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং ভবিষ্যতে কীভাবে এগুলো প্রভাবিত হতে পারে সেটার গুরুত্ব বোঝানো এবারের প্রতিপাদ্য। বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা পেশা হিসেবে নার্সদের অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
- লেখক: নার্স ও পুষ্টিবিদ,কক্সবাজার; [email protected]