সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও ইসরায়েলের মাথাব্যথার কারণ যে নতুন ফিলিস্তিনি প্রজন্ম
ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্র স্থান ও প্রথম কিবলা মসজিদুল আল আকসা (হারাম আল শরীফ)। পবিত্র স্থানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংঘাত চলে আসছে। সম্প্রতি এই সংঘাত জন্ম দিয়েছে প্রচণ্ড বিক্ষোভ।
অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করা ফিলিস্তিনি ভূমিপুত্রদের দমনে ইসরায়েলের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নতুন নয়। তেমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন মধ্যবয়সী ফিলিস্তিনি এক গৃহবধূ। আল আকসা মসজিদের খুব কাছে পূর্ব জেরুজালেমে বাড়ি তার। সোমবার তিনি আসরের নামাজ আদায় করতে যান আকসায়, তারপর বাড়ি ফিরেই সন্ধ্যেবেলা মুঠোফোনে একটি এসএমএস পান। সেখানে লেখা ছিল, "মারহাবা, আল আকসায় তোমাকে সংঘাতপূর্ণ আচরণে অংশ নিতে দেখা গেছে। অবশ্যই, এর বিচার হবে- ইতি ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগ।"
ওই গৃহবধূর বয়স এবং স্থূলগড়ন বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, শত শত ফিলিস্তিনি তরুণদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার ইসরায়েলি পুলিশের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়ানোর সম্ভাবনা নেই বলেলেই চলে। ইতঃপূর্বে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী হারাম আল শরীফে হামলা করলে ওই সংঘাত মারাত্মক আকার ধারণ করে। পাথর ও আতশবাজি ছুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে তরুণেরা।
তবে শুধু ওই গৃহবধূ নয়, ওই সময় হারাম আল শরীফের আশেপাশে থাকা অনেকে ফিলিস্তিনি তাদের ফোনে এমন বার্তা পেয়েছেন। এদের মধ্যে সিএনএন- এর স্থানীয় প্রোডিউসার করিম খাদেরও আছেন।
খাদের বলেন, 'এসএমএস পাঠানো নম্বরে আমি ফোন করেছিলাম, কিন্তু সেটি বন্ধ ছিল। নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই, সেটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগের, নাকি অন্য কারো।'
কিন্তু, ইহুদীবাদী রাষ্ট্রের এমন হুমকি ফিলিস্তিনিদের জন্য নিত্য-নিয়মিত ঘটনা। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হুমকি নির্যাতন বা নিরুদ্দেশে রূপ নেওয়া অস্বাভাবিক নয়।
সত্যিকার অর্থে, ২১ শতকে বিক্ষুদ্ধ একটি জনসংখ্যাকে দমন করার কারিগরি সব ধরনের সক্ষমতা ইসরায়েলের আছে।
পুরোনো শহরখ্যাত পূর্ব জেরুজালেমের প্রাচীন অংশে বাসকারী প্রতিটি ফিলিস্তিনির গতিবিধির ওপর সব সময় নজর রাখে ইসরায়েলি ড্রোন ও শত শত সিসিটিভি ক্যামেরা। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ দমনে শহরের রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন রয়েছে হাজার হাজার সশস্ত্র পুলিশ। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে পুঁতিগন্ধময় পানিবাহী ট্রাকও তাদের নয়া হাতিয়ার। খোদ ইসরায়েলি পুলিশই একে 'নর্দমার জল' নাম দিয়েছে, যা বিক্ষোভকারী, পথচারী, আশেপাশের দোকানপাট, বাসাবাড়ি সবকিছুর ওপর ছিটানো হচ্ছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর খ্যাতি-কুখ্যাতি যাই বলা হোক না কেন- পুরোদমেই আছে। পশ্চিমা সমর্থনের কল্যাণে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত অস্ত্রসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীগুলোর একটি ইসরায়েলের। আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করা হলেও রাষ্ট্রটি পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী।
এত কিছু থাকার পরও সাম্প্রতিক বিক্ষোভ দমনে হিমশিম খাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জেরুজালেমের মূল সড়ক আর গলিপথগুলোয় অবস্থান নেওয়া ফিলিস্তিনিরা, যাদের অধিকাংশই আবার তরুণ।
১৯৬৭ সালে পুরোনো শহরসহ পূর্ব জেরুজালেম দখল করে ইসরায়েল। তেল আবিবের দাবি, আজ শহরটির বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ! কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলি ইহুদি নাগরিক এবং আরব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন।
পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের সব দাবি মেনে নিলেও, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন 'দ্বি-রাষ্ট্র' সমাধানেই বিশ্বাস করেন বলে জানিয়েছেন। এই ব্যবস্থায় আলাদা দুটি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশীর মতো বসবাস করতে পারবে, এমন অনুমান আরোপ করে পশ্চিমা বিশ্ব।
অনুমানটি অলীক কল্পনা বললেও ভুল হবে। সেই সমাধানের পথ অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে পরিকল্পনার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ফিলিস্তিনিরা, ২০১৮ সালে গাজা সীমান্তে জন্ম নেয় সুতীব্র বিক্ষোভ, যা দমনে নৃশংসভাবে গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনারা।
'দ্বি-রাষ্ট্র' পরিকল্পনা তখনই মৃত হলে, আজ তার শব পচে গেছে। পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দখলের পাল্লায় বংশ পরস্পরার আবাস হারিয়েছে অজস্র ফিলিস্তিনি পরিবার। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে যেসব নতুন বসতি স্থাপন করা হয়েছে, তাও করা হয়েছে ফিলিস্তিনি ভূমির ওপর, অথচ অসলো শান্তি চুক্তিতে এসব ভূমিসহ স্বাধীন পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। আজ সংশ্লিষ্ট যে কেউ স্বীকার করবে, ওই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব।
ইসরায়েলের কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী নিজ রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও কূটনৈতিক প্রভাবের সবটুকু ফিলিস্তিনীদের অধিকার হরণে নিয়োজিত করেছেন। তাছাড়া, রাজনৈতিক ভাবেও তার অবস্থান শক্ত নয়, সাম্প্রতিক সময়ে পর পর কয়েকটি নির্বাচনে কোনো পক্ষই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনোপ্রকার আপোষকে 'অভিশাপ' মনে করা আরও কট্টরপন্থী ডানপন্থীদের তোষণ করছেন নেতিনিয়াহু। ইসরায়েলে ক্ষমতার কেন্দ্র এখন কার্যকরভাবেই প্রচণ্ড কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর দখলে।
অন্যদিকে, পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ৮৫ বছরের মাহমুদ আব্বাসের সরকার এবং হামাস নেতৃত্বাধীন গাজার সরকারের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে বিভাজিত ফিলিস্তিনীরা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবজ্ঞায় তাদের বুকে পাহাড়প্রমাণ বেদনা ও অসন্তোষের বোঝা। আব্বাসের পিএলও সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি এবং হামাস সরকারের স্বৈরাচারী আচরণেও বিরক্ত অনেকেই।
নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তীনীরা এই দশার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে, ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে চমকে দিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল শক্তি প্রয়োগ করছে, আর পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ নখদন্তহীন তর্জন-গর্জনের আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানিয়ে রকেট হামলা চালাচ্ছে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী। কিন্তু, এসব কোনো প্রতিক্রিয়াই ইতিবাচক ফল আনবে না।
নিজ নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলি আইন কার্যকর হলেও, ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণে সামরিক আইন প্রয়োগ চলছে দীর্ঘকাল ধরে। খোদ ইসরায়েলের একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী এধরনের বৈষম্যকে পরিকল্পিত বর্ণবাদ বলেছে। বঞ্চণা-ক্ষোভের জন্ম সেখান থেকেই, একের পর এক ভূমি ইসরায়েলের দখলে যেতে দেখা ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্ম আগের চাইতেও ক্রুদ্ধ, নেতৃত্বের ঐক্য না থাকলেও তাদের আজ হারানোর কিছুই নেই।
- সূত্র: সিএনএন